muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

অপরাধ

মা, আয়শা আমারে পাচার কইরে দেছেঃ আঞ্জুয়ারা

aysha
মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠঃ মালয়েশিয়াগামী বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের নাগরিকদের সাগরে ভেসে থাকা, মৃত্যু, বিভিন্ন দেশে কারাভোগ, থাইল্যান্ডের জঙ্গল থেকে কয়েক শ নাগরিককে উদ্ধার- এসব ঘটনায় সারা দেশে মানবপাচারের বিষয়টি এখন বহুল আলোচিত। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ইন্দোনেশিয়া ছাড়াও সুদূর মধ্যপ্রাচ্যেও দেদারসে পাচার হচ্ছে নারী-পুরুষ।

আঞ্জুয়ারা এসব পাচার হওয়া নারীদের একজন। যশোরের শার্শা উপজেলার গাজীপুর গ্রামের রবিউল ইসলামের মেয়ে তিনি। সম্প্রতি ওমান থেকে মায়ের কাছে ফোন করেন আঞ্জুয়ারা। আঞ্জুয়ারা জানান তিনি পাচারের শিকার হয়েছেন। আয়েশা নামে এক দালাল তাকে পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে জানান তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে আকুতি জানান তাঁকে উদ্ধারের।

আঞ্জুয়ারা বলেন, “মা, আয়শা আমারে পাচার কইরে দেছে মা। জানি না, জীবনে ফিরতে পারবো কিনা, আল্লা-আল্লা করো। আমি যে কত কষ্টে আছি মা, তুমি জানো না। ঘরের মধ্যে আটকাইয়ে রাখে, খাবার দেয় না, মারধর করে, অত্যাচার করে।” তিনি বলেন, “এইখানে আরো ৫০ জন আছে, নানান দেশের। সগলের একই অবস্থা। তুমি সগলরে কও, বাংলাদেশের মেয়েগোরে আপনারা আর পাঠায়েন না। মা, তুমি আয়শারে পিঠমোড়া দিয়ে বান্ধ। আর আমার এই কথা সগলরে শুনাও। দালালরে কও, আমারে যেন দেশে নিয়ে যায়।”

আট বছর আগে দুই সন্তানসহ আঞ্জুয়ারাকে ফেলে নিরুদ্দেশ হন তাঁর স্বামী। এরপর তিনি আশ্রয় নেন দরিদ্র পিতা-মাতার সংসারে। একপর্যায়ে একই গ্রামের নূর হোসেনের মেয়ে আয়েশা খাতুন তাঁকে ভালো চাকরিসহ দুবাই পাঠানোর লোভ দেখান। পরিবারের সহায় বলতে যে একটুকরো জমি ছিল, তা বন্ধক রেখে আয়েশার হাতে দেড় লাখ টাকা তুলে দেন আঞ্জুয়ারা। কিন্তু আয়েশা তাঁকে দুবাই না পাঠিয়ে ওমানে এক দালালের কাছে বিক্রি করে দেন। গত পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে সেখানে তাঁর ওপর চলছে অমানুষিক নির্যাতন।

আঞ্জুয়ারার বাবা রবিউল ইসলাম বলেন, “দুবাই নেওয়ার কথা বলে দেড় লাখ টাকা নিছে। কিন্তু ওমানে দালালদের কাছে বেইচে দিছে। এখন আরো এক লাখ টাকা চাচ্ছে। দিতে পারছি না বলে আমার মেয়ের ওপর অত্যাচার করছে।” তিনি বলেন, “পাঁচ মাস হলো আমার মেয়ের কোনো খবর নেই। এ ঘটনা লোকজনরে বলায় ওরা উল্টো আমাদের নামে মামলা দিয়েছে। পুলিশ আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। পরিবারের সবাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। এখন আমি কী করব? আমার মাইয়েরে কীভাবে ফেরত আনব?”

আঞ্জুয়ারার মতো যশোর অঞ্চলের শতাধিক নারীর বন্দিজীবন কাটছে ওমানে। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৫০ জনের পরিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সহায়তা চেয়ে আবেদনও করেছে। ওমানে আটকে থাকা যশোর সদর উপজেলার নূরপুর গ্রামের সাথী বেগমের স্বামী কবির হোসেন বলেন, “আমার স্ত্রী কানতে কানতে বলতেছে, আমারে খুব মারতেছে, আমারে বাঁচাও, আমি তো অসহায় হয়ে পড়তিছি। সবাই হাত-পা ধরতিছি, কেউ টাকা দেচ্ছে না। এক জায়গা থেকে সুদে ৪০ হাজার, আরেক জায়গা থেকে ১০ হাজার নিয়ে দিইছি। এখন আরও ৬০ হাজার চাচ্ছে দালাল তফিকুল মণ্ডল। আমি চার দোকান দিয়ে সংসার চালাই। প্রথমে দেড় লাখ টাকা তো দিছিই। এখন ৪০ হাজার টাকায় প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা সুদ দিতি হবে। আমি এখন কী করব?’

মানবপাচার রোধে যশোর অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে রাইটস যশোর নামে একটি মানবাধিকার সংগঠন। সংগঠনটি নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, “২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত যশোরে মানব পাচারের অভিযোগে ৩৭২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৬টি মামলার রায় হয়েছে। একটিতেও কারো সাজা হয়নি। পুলিশের ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত এবং সাক্ষীদের ঠিকমতো হাজির করতে না পারার কারণেই অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ ছাড়া মামলা চলাকালে স্থানীয় প্রভাবশালীরা দুই পক্ষের মধ্যে টাকা-পয়সার মাধ্যমে মীমাংসা করিয়ে ফেলছে। এ কারণে মানব পাচারকারীদের শাস্তি হচ্ছে না।

যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কে এম আরিফুল হক বলেন, “যশোর থেকে কতজন পাচারের শিকার হয়েছেন- তা এখনই বলা যাচ্ছে না। আগে কেউ অভিযোগ করতে আসেনি। তবে এখন আসছে। আমরা চেষ্টা করছি পাচারের শিকার লোকদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার।”

১৯ মে ২০১৫/ এম ইউ

Tags: