muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

আন্তর্জাতিক

২০০ বছরের ব্রিটিশ শোষণের ক্ষতিপূরণ চেয়ে প্রশংসিত হলেন শশী

image_248460.oxfordunion+2
অক্সফোর্ড ইউনিয়নে ভারতের সাবেক মন্ত্রী শশী থারুরের দেওয়া এক বক্তৃতায় যুক্তরাজ্যের কাছে ঔপনিবেশিক আমলের শোষণ-নিপীড়নের ক্ষতিপূরণের দাবি অনলাইনে তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। গত ১০ দিনে ইউটিউবে ১৫ মিনিটের ওই বক্তব্যের ভিডিও দেখা হয়েছে ১৫ লাখেরও বেশি বার।
শশী থারুর তার বক্তৃতায় বলেন,

ব্রিটিশরা যখন ভারতবর্ষে তরী ভেড়ায়, সে সময় বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অবদান ছিল ২৩ শতাংশ। আর ব্রিটিশরা যখন চলে গেল, ততদিনে তা ৪ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
”কেন? শুধু এই কারণে যে, ভারতকে তখন শাসন করা হয়েছে ব্রিটেনের লাভের জন্য। ২০০ বছর ধরে ভারতে লুটপাট চালিয়ে ব্রিটেনের উন্নতির অর্থ যোগানো হয়েছে।”
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ডিবেটিং সোসাইটি অক্সফোর্ড ইউনিয়নের এ বিতর্ক অনুষ্ঠানে ভারতের পার্লামেন্ট সদস্য, সাবেক কূটনীতিক শশী থারুর ছিলেন আট বক্তার মধ্যে সপ্তম। সাবেক উপনিবেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায় ব্রিটেনের আছে কি না, তাই এ বিতর্কের বিষয় ছিল বলে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়।
অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ও স্পষ্ট বক্তব্যে ড. থারুর আর্থিক ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি ব্রিটেনের ‘নৈতিক’ দায় স্বীকারের ওপর জোর দেন।
ভারতীয় উপমহাদেশের তাঁতশিল্প ধ্বংসের ইতিহাস মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ”আসলে, ভারতের শিল্প বিনাশ করেই ব্রিটেনের শিল্প বিপ্লব সম্ভব হয়েছে।”
তখন ঢাকাই মসলিনের বেশ কদর ছিল ইউরোপে। বস্ত্রশিল্পের জন্য বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের খ্যাতি ছিল ব্রিটেনেও।
শশী থারুরের ভাষায়, সেই সব দিনে ভারতবর্ষ ছিল ব্রিটেনের আয়ের ‘সবচেয়ে বড় উৎস’, ব্রিটিশ পণ্যের ‘সবচেয়ে বড় ক্রেতা’ এবং ব্রিটিশ সরকারি চাকুরেদের ‘মোটা বেতনের যোগানদাতা’।
”আক্ষরিক অর্থেই, নিষ্পেষিত হওয়ার বিনিময়ে আমাদের পয়সা দিতে হয়েছে,” বলেন তিনি।
থারুর বলেন, ব্রিটিশ আমলে ভারতবর্ষে দেড় থেকে প্রায় তিন কোটি মানুষকে দুর্ভিক্ষে জীবন দিতে হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলা অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের (পঞ্চাশের মন্বন্তর) ইতিহাস তুলে ধরে ভারতীয় কংগ্রেসের এই নেতা বলেন, তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের নীতির কারণেই সে সময় ৪০ লাখ মানুষকে মরতে হয়েছিল, কেননা তিনি জরুরি খাদ্যপণ্য মজুদ করেছিলেন ব্রিটিশ সৈনিকদের জন্য। আর খাবার না পেয়ে মানুষের মৃত্যুর খবর জানানো হলে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন- ‘গান্ধী কি মরেছে?’
শশী থারুর বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের সমর ব্যয় যোগাতে ভারতবর্ষকে যে অর্থ দিতে হয়েছিল, আজকের বাজার দরে তার পরিমাণ আট বিলিয়ন পাউন্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালের হিসেবে ব্রিটেনের খরচ হয়েছিল ৩ বিলিয়ন পাউন্ড, যার মধ্যে সোয়া ১ বিলিয়ন পাউন্ড যোগাতে হয়েছিল ভারতকে। সেই অর্থ কখনোই ভারতকে ফেরত দেওয়া হয়নি।
ঔপনিবেশিক শোষণে ভারতের আর্থিক ক্ষতির যে হিসাব শশী থারুর দিয়েছেন, তার কোনো তথ্যসূত্র তিনি উল্লেখ করেননি। তবে বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া তথ্যে থারুরের বক্তব্যের সমর্থন রয়েছে বলে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়।
ব্যবসা করতে এসে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি দেশ দখলের পর ১৭৫৭ সালে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শুরু হয়। ১৮৫৮ সালে ভারতবর্ষ সরাসরি ব্রিটিশ রাজের অধীনে আসে; সেই শাসন চলে ১৯৪৭ পর্যন্ত।
যুক্তরাজ্যের ইনডিপেনডেন্ট অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক কলোনিগুলোতে দাস ব্যবসা ও শোষণের কারণে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকেই আলোচনায় থাকলেও ব্রিটিশ নেতারা কখনোই গা করেননি।
২০১৩ সালে ভারত সফরে এসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার ঘটনাস্থলে যান, যেখানে ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল কয়েকশ স্বাধীনতাকামীকে হত্যা করে ব্রিটিশ সেনারা।
ক্যামেরন সেই হত্যাকাণ্ডকে ‘ন্যক্কারজনক’ বললেও সরাসরি ক্ষমা না চাওয়ায় সে সময় ভারতে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয় তাকে।
ক্ষতিপূরণের এই দাবি যে নতুন কোনো বিষয় নয়, তা বোঝাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের জন্য ইসরায়েল ও পোল্যান্ডকে জার্মানির ক্ষতিপূরণ, লিবিয়াকে ইটালির এবং কোরিয়াকে জাপানের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বিতর্কে তুলে ধরেন শশী থারুর। এমনকি নিউজিল্যান্ডের মাউরি আদিবাসীদের ব্রিটেনের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও তিনি মনে করিয়ে দেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের কারণে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার এবং ক্ষতিপূরণের দাবি রয়েছে বাংলাদেশেও। ২০১০ সালে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও হয়।
অক্সফোর্ড ইউনিয়নের বিতর্কে অপর পক্ষের যুক্তি ছিল, ব্রিটিশ শাসনের কারণে ভারত উপকারও পেয়েছে; সুতরাং ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন এখানে আসে না।
যুক্তি হিসেবে ভারতজুড়ে ব্রিটিশদের রেলপথ নির্মাণের কথা তুলে ধরেন এক বক্তা।
এর জবাবে শশী থারুর বলেন, যেসব দেশ কখনো কারও কলোনি ছিল না, তারাও রেলপথ নির্মাণ করছে। আর ব্রিটিশরা ভারতের মানুষের টাকায় সে সময় রেলপথ বানিয়েছিল নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে।
বেশ কয়েকটি বইয়ের লেখক এই ভারতীয় রাজনীতিবিদ বক্তব্যের এক পর্যায়ে রসিকতা করে বলেন, ”ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য ডুবত না, কারণ খোদ ঈশ্বরও অন্ধকারে ইংরেজদের বিশ্বাস করতে পারতেন না।”
ব্রিটেনের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিৎ কি-না, সে বিষয়টিই আলোচকদের বক্তব্যের কেন্দ্রে ছিল; কেউ নির্দিষ্ট করে কোনো অংক বলেননি।
শশী থারুর তার বক্তব্য শেষ করেন ‘নৈতিক ক্ষতিপূরণের’ ওপর জোর দিয়ে।
তিনি বলেন, যে ভুল করা হয়েছে, তা স্বীকার করে নিলে, স্রেফ ‘স্যরি’ বললেও জিডিপির একটা অংশ ধরে অর্থ সহায়তা দেওয়ার চেয়ে ‘ঢের বেশি অগ্রগতি’ হতে পারে।
”যেটা দরকার, তা হল- দায় থাকার বিষয়টি নীতিগতভাবে স্বীকার করে নেওয়া। ভারতে ব্রিটেনের ২০০ বছরের জন্য আগামী দুই শ বছর যদি ১ পাউন্ড করেও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, তাতে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি থাকব।”
এ বিতর্কে শশী থারুরের সঙ্গে ছিলেন যুক্তরাজ্যে জ্যামাইকার হাই কমিশনার দোমবেট অ্যাসাম্বা ও ঘানার অর্থনীতিবিদ জর্জ আয়েত্তি।
তারা ১৮৫-৫৬ ভোটে বিতর্কে বিজয়ী হন বলে ইনডিপেনডেন্টের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়।
অক্সফোর্ড ইউনিয়নের বিতর্ক সেদিন শেষ হলেও সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে শশী থারুরের বক্তব্য নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে।
অভিনয় থেকে ভারতের রাজনীতিতে আসা পরেশ রাওয়াল এক টুইটে বলেছেন, ড. থারুরের ওই বক্তব্যে তিনি মুগ্ধ।
এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এই কংগ্রেস নেতার বক্তব্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মোদির দৃষ্টিতে, শশী থারুরের বক্তব্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের প্রকাশ ঘটেছে।

Tags: