muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

দেশের খবর

নান্দাইলে বিলুপ্তর পথে গরুটানা হালচাষ পদ্ধতি

hal chash
নান্দাইল প্রতিনিধি : কালের বিবর্তনে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে মানব সভ্যতার সোনালী অতীত, ঐতিহ্য ও নানা আবিষ্কারের ইতিহাস। এরই একটি হচ্ছে গরু দিয়ে হালচাষ পদ্ধতি। মানব সভ্যতার ঊষালগ্নে জমিচাষে কাঠের তৈরী চাঁদ আকৃতির লোহার ফলাযুক্ত লাঙ্গল ও পশু ব্যবহারের মাধ্যমে ফলানো হতো সোনালী ফসল। আর এটিই ছিলো তখনকার একমাত্র চাষ পদ্ধতি। বর্তমানে আধুনিক সভ্যতার নিরন্তর প্রচেষ্টায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভাবনীয় সাফল্যের যুগে কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যাপক বিস্তার ও ব্যবহারে উন্নত কৃষি পদ্ধতির মোকাবেলায় টিকে থাকতে পারছে না সেকালের সেই লাঙ্গলের জমিচাষ পদ্ধতি।

ফলে প্রত্যন্ত পল্লীতেও এখন আর দেখা যায়না তেমন একটা গরুটানা লাঙ্গলের হাল। অতীত যেন হারিয়ে যাচ্ছে বর্তমানের গহ্বরে। আমাদের দেশে ৯০ দশক পর্যন্ত ওই হালচাষ পদ্ধতি ছিলো কৃষি উৎপাদনের একমাত্র উপায়। সেই হারিয়ে যাওয়া লাঙ্গলের হাল যারা পরিচালনা করতো তাদেরকে গ্রাম্য ভাষায় ‘হাইল্যা’ বলা হতো। সেই হালচাষীরা ভোররাতে উঠে প্রাথমিক সকল প্রস্তুতি সেরে কোমরে ও মাতায় গামছা বেঁধে এক হাতে হালের বলদের রশি ধরে, কাঁধে লাঙ্গল, লাঙ্গলের ডগায় খড়ের বেদীতে আগুন ধরিয়ে জোঁয়াল-মই নিয়ে চলতো মাঠে। তাদের নাওয়া-খাওয়া হতো ক্ষেতের আইলে বসেই। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ভোর থেকে বেলা গড়া পর্যন্ত চলতো তাদের হালচাষ। অনেক সময় দ্রুত জমি চাষের জন্যে পাড়ার গৃহস্থরা মিলে গাতা করে পালাক্রমে একে অপরের জমি চাষে সাহায্য করতো। সারিবদ্ধ ভাবে জমি চাষের সময় হাইল্যারা মনের সুখে একসঙ্গে উচ্চ কণ্ঠে গেয়ে উঠতো কতনা জারি, সারি, ভাটিয়ালী সেই বিখ্যাত ভাওয়াইয়া এখন আর শোনা যায়না। বেলা গড়া পর্যন্ত হালচাষ শেষে বাড়ীতে ফিরে দুপুরের নাওয়া-খাওয়া শেষ করে ফের জড়িয়ে পড়তো অন্য গৃহস্থালী কাজে। রাত অবধি চলতো তাদের সেইসব গৃহস্থালীর কাজ। কতইনা ব্যস্ত ছিলো তারা উৎপাদনমুখী কাজে। তাদের কাছে শোভা পেতো তামাকের তৈরী বিড়ির প্যাকেট। মনের সুখে বিড়ি টেনে যেন অমৃতের স্বাদ পেতো তারা। অনেক সময় শীতের মৌসুমে বিড়ি না ধড়ালে তারা কৃষিকাজ করতে পারতো না। কৃষকরা বলে বিড়ি না ধরালে এ কনকনে ঠাণ্ডাতে মরেই যেতে হবে ভাই। একখান বিড়ির টানে মনের সুখে তারা সে মুহুর্তে নিজের কাজে মেতে থাকতো। আশি’র দশকের শুরুতে আমাদের দেশে কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার শুরু হয় সামান্যই। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট ও কৃষিবিজ্ঞানীরা কৃষি যন্ত্রপাতির উদ্ভাবনের কাজে হাত দেন আশি’র দশকের গোড়ার দিকে এবং পরবর্তীতে উন্নত সংষ্করণ তৈরী করতে থাকেন। ধীরে ধীরে নব্বই দশকের দিকে তার পরিধি ব্যাপক আকার ধারণ করে। যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা, ব্যবহারে সুবিধা থাকায় অতি অল্প সময়ে ট্রাক্টরের মাধ্যমে জমিচাষ, ফসলমাড়াই, বস্তাবন্দি, রোপন, নিড়ানী, সার প্রয়োগ ও ফসল কাটা পর্যন্ত সব কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক সব যন্ত্রপাতি। তাই ক্রমাগতভাবে বদলে যাচ্ছে কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের কৃষিকাজের চিরায়ত চিত্ররূপ। আশি’র দশক পর্যন্ত গ্রামীণ শ্রমশক্তি উদ্বৃত্ত থাকায় কৃষকরা কৃষিকাজে যন্ত্রপাতির ব্যবহারে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। কারণ তখন যন্ত্রপাতি ছিলো সম্পূর্ণ আমদানী নির্ভর। ক্রয়ক্ষমতাও ছিলো কৃষকদের নাগালের বাইরে। এরপর দেশে নানাবিধ শিল্প কল-কারখানা গড়ে উঠায় ও দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিল্প-বাণিজ্যে ও পরিবহণসহ সকল সেবামূলক খাতের প্রসার ঘটতে থাকায় কৃষিকাজে শ্রমশক্তির অভাব দেখা দেয়। বেড়ে যায় শ্রমের মজুরীও। একদিকে শ্রমের মূল্য বৃদ্ধি, শ্রমশক্তির অভাব, অন্যদিকে দেশেই কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরী হওয়া ও সহজলভ্যতার কারণে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে এর বিস্তর ব্যবহারের দিকে কৃষকরা ঝুকে পড়ে। প্রযুক্তির ব্যবহারে কৃষিকাজের সময় ও শ্রম, ফসলের অপচয় কমে আসে। এতে কৃষিজমি প্রতিবছর কমলেও শস্য উৎপাদন বাড়ছে দ্বিগুণ হারে। কৃষিতে যন্ত্রীকরণের ফলে ইউরিয়া প্রয়োগ ও ব্যবহারে সাশ্রয় হয়েছে। ফসল কাটা-মাড়াই ও যন্ত্রচালিত মেশিনে ফসল মাড়াইয়ের অপচয়ও অনেকটাই কমে গেছে। এভাবেই কৃষিতে যন্ত্রপাতির ব্যবহারের ক্ষেত্র দিন দিন বেড়েই চলছে। কৃষিতে যন্ত্রপাতির ব্যাপক ব্যবহার ও চাহিদার ফলে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি তৈরীর এক সৃজনশীল পরিবেশ তৈরী হয়েছে। উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহারে শ্রম-ঘাম অপচয় যতই রোধ হোক না কেন, আমাদের আদি ঐতিহ্য যে হারাতে বসেছে এটা ধ্র“ব সত্য। অতীত ছাড়া বর্তমানকে স্বাবলম্বী করা কঠিন। তাই পুরাতনকে শুধুই ইতিহাসের পাতায় নয়- বাস্তবে কিছুটা হলেও ধরে রাখা দরকার। এখন যেন সবই অতীত। আজকের প্রজন্মের সেই আদি ঐতিহ্য গরুটানা লাঙ্গলের হালের সাথে পরিচয় নেই বললেই চলে। হয়তোবা একদিন লাঙ্গলের হাল দেখতে যেতে হবে যাদুঘরে।

Tags: