muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

প্রচ্ছদ

তাগড়া, বুলেটে ঝাঝরা হতে হতে বেঁচে উঠেছে অমরত্বের পুণর্জন্মে

মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ রিপোর্টঃ 

অপ্রস্তুতভাবে সামনা সামনি দেখা হওয়া শত্রু এবং আমাদের ছেলেদের মাঝে দুরত্ব মাত্র ২০০/২৫০ গজ। এখান থেকে নিরাপদে কোনো পক্ষেরই যুদ্ধ ছাড়া পশ্চাদপসরণ করা সম্ভব না। দু’পক্ষই কেবল মাটিতে শুয়ে অবস্থান নিয়ে আছে। এলাকাটি বরিশালের উত্তরে।

অপেক্ষার অবসান টানলো শত্রুর এক বিশালদেহী সৈনিক। এসএমজি’র ব্যারেল ডান হাতে এবং কাঠের স্টক বাট মাথার উপর উঁচু করে বাম হাতে ধরে দাঁডিয়ে গেল। কমান্ডার সাঈদের প্রতিরক্ষা থেকে অবাক যোদ্ধারা কেউই গুলি করলো না। ন’মাসের ক্লান্তিকর যুদ্ধ বোধকরি একে বিরক্তির চুড়ান্ত সীমান্ত পৌঁছে দিয়েছে। নিস্তব্ধতা ভেঙে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগলো,’হ্যায় কোয়ি মা কি লাল? মা কি দুধ পিয়া হো তো বেগায়ার হাতিয়ারকে সামনে আ যাও।’ (আছো কোনো মায়ের ছেলে? মা’র দুধ যদি পান করে থাকো তাহলে বিনা অস্ত্রে সামনে এগিয়ে আসো)। কথা শেষ করে সবার সামনে এসএমজিটা ১০/১৫ গজ দুরে ডান দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তারপর একটানে ইউনিফর্মের সাটর্টির বোতাম ছিঁডে গা থেকে খুলে ফেলে দিলো বাম দিকে। আমাদের ছেলেরা হতবাক হয়ে দেখছে শত্রুর এক সৈনিকের কান্ড। এবার সে এক পা দু’পা করে আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের দিকে এগুতে থাকলো।

লুঙ্গিপরা উদাম দেহের ভোলার চর দখলের লডাকু বিশালদেহী তাগড়া আর সইতে পারলো না। তার দেশে হানাদার শত্রু দ্বন্দযুদ্ধ আহ্বান করে বিনা মোকাবেলায় চলে যাবে? হঠাৎ করে দাঁডিয়ে লুঙ্গির কোচ গুঁজতে গুঁজতে কাউকে উদ্দেশ্য না করেই বলতে লাগলো,’মরদো মনে হরছে কি? বাঙালিগো মধ্যে কি কেউ নাই যে ওর লগে বোঝতে পারে?মেবাই তাগড়ারে আর ধইরা রাখতে পারলেন না। হালার পো হালায় বে-জাগায় হাত দেছে’। ‘জয় বাংলা’ বলে তাগড়া শত্রু সৈন্যটির দিকে এগুতে লাগলো। আমাদের সবাই নির্বাক,বোধহয় শত্রুও। দু’পক্ষেরই যেন এ দ্বন্দযুদ্ধ দেখবার মৌন সমর্থন।

দু’জনই এগুতে এগুতে সামনা-সামনি হলো। আধুনিক যুদ্ধে এক মধ্যযুগীয় যুদ্ধের মহডা। এ এক যুদ্ধের নাটক,নকি নাটকের যুদ্ধ? কয়েক সেকেন্ড দু’জনই মুখোমুখি দাঁডিয়ে রইলো। এবার তাগড়া তার ডান হাতের খোলা আঙ্গুলের সজোর থাবা বসিয়ে দিল শত্রুর বাম বুকের উপর। থাবার প্রচন্ড ভরবেগে শত্রুর সৈনিক পিছিয়ে গিয়ে পড়তে পড়তেও দু’পায়ের উপর ভর করে দাঁড়াতে পারলো। তাগড়াও পিছিয়ে গেল কয়েক পা। এদের মধ্যে দুরত্ব বেড়ে হলো ৪/৫ গজ। এমন সময় শত্রুর প্রতিরক্ষা অবস্খান থেকে স্বযংক্রীয় অস্ত্রের কয়কটি বার্স্ট এসে তাগড়াকে ঝাঝরা করে দেয়। তাগড়া পিঠের উপর ভর করে আর একটুও নডতে পারেনি। শত্রুর সৈনিকটি লাফিয়ে গিয়ে পডলো তার প্রতিরক্ষা অবস্থানে।

আমাদের ছেলেদের তখন মাথায় রক্ত উঠে গেছে। কমান্ডার সাঈদ তার সিগন্যাল পিস্তল থেকে পরপর দু’টি লাল রাউন্ড আকাশে ছুডলো। মুহুর্তেই নিরস্ত্র এলাকাবাসীসহ সম্মুখ আক্রমনে দখল করা হলো শত্রুর অবস্খান। দ্বন্দযুদ্ধ আহ্বানকারী সৈনিকটি মরে পড়ে আছে শরীরে পাঁচটি গুলির আঘাত নিয়ে। একশ’রও বেশি সৈন্যের মধ্যে পাঁচজনকে মাত্র জীবিত পাওয়া গেল,আর সবাই মৃত। যুদ্ধবন্দী সৈন্যরা জানালো যে,তাগড়ার ওপর গুলি করার পর সৈনিকটি ফিরে এসে মৃত একজনের একটি এসএমজি নিয়ে নিজেদের সব সৈনিকদের গুলি করে হত্যা করেছে আর অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেছে কাপুরুষের মতো তাগড়াকে গুলি করার জন্য।

তাগড়া চর দখল করতে গিয়ে আঘাতে মরেনি।হতভাগাটা ‘অযোদ্ধা’ আর ‘খবর্কায়’ বাঙালি’র অপবাদ ঘোচাতে গিয়ে মরলো । আর বুলেটে ঝাঝরা হতে হতে বেঁচে উঠেছে অমরত্বের পুণর্জন্মে। সেই সঙ্গে ছিনিয়ে এনেছে রণাঙ্গণে জয়-পরাজয়ের বাইরেও এক মহত্তম বিজয় — সাহসের অক্ষরে লেখা বাঙালির আত্মমর্যাদা।

 

লেখকঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রদ্ধেয় মেজর (অব:) কামরুল হাসান ভুঁইয়া।

তথ্য সূত্রঃ গেরিলা ৭১।

 

মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ ডটকম/১২-১২-২০১৬ইং/ অর্থ 

Tags: