muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

সাহিত্য ও সংস্কৃতি

অনন্ত : মাফতুন আলম

সাহিত্য ও সংস্কৃতি ।। অনন্ত মন খারাপ থাকলে সিডনির সেন্ট্রাল হয়ে মিউজিয়াম হয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাইড পার্কে ঢুকে পড়ে। ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত হাঁটে তারপর এনজাক মেমোরিয়ালে বসে থাকে একা একা। ছেলেবেলার কথা ভাবে। বাবার কথা মনে করে।
স্কুলে নামিয়ে দিয়ে গেলেন বাবা– সেই শেষ দেখা বাবাকে। ঐদিনই বাবা গাজিপুরের চৌরাস্তায় গাড়িতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। অনন্ত তখন ক্লাশ সেভেনে পড়ে। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই মা বদলে গেলেন,গম্ভীর হলেন। মার ইচ্ছেতেই অনন্ত এ লেভেল শেষ করে সিডনিতে আসে গ্র্যাজুয়েশন করতে। বাবার মৃত্যুর পর অনন্তই মার বন্ধু হয়ে উঠে। অনন্তই মার পৃথিবী।প্রতিদিন মার সঙ্গে অনন্তর কথা হয়। অনন্ত খুটিনাটি সবকিছুই মাকে বলে। না বললে অস্থির লাগে। বাবার সঙ্গেও কথা বলে– তবে মনে মনে।
– ও বাবা তুমি গেলে কেন? তোমার আদর পেতে ভীষণ ইচ্ছে করে বাবা।
– ঠিক আছে আমার আদরের কোন দরকার নেই।
– তুমি শুধু আমার বুকের ভিতরে জমে থাকা একদলা কষ্টটুকু নিয়ে যাও।
– মার খুশিও নিয়ে গেলে? মার খুশি ফিরিয়ে দাও!!
– ও বাবা আমার হাউসমেটদের বাবারা যখন ফোনে ওদের সঙ্গে কথা বলে তখন আমার বুকের ভিতরের একদলা কষ্ট কাঁপতে থাকে। আমার কপালে তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। তোমার মুখচ্ছবি আমি স্পষ্ট দেখি। আমি তখন এক অতল ঘোরের মধ্যে থাকি।
– তুমি কি একটা ফোনও করতে পারো না?
– ও বাবা তুমি গেলে বলেই তো মা এমন করে বদলে গেল।
– তুমি নেই বলেইতো মাকে কতোনা বিরম্বনা সইতে হলো!
– মার খুশি আর দেখতে পাই না। লুকিয়ে লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মা কাঁদে।
– এমন কান্না দেখলে তোমার বুকেও কষ্ট জমা হতো আমারই মতো!
ঘাতক ড্রাইভার এর শাস্তি পর্যন্ত হলো না,অপরাধীর শাস্তি হলো না বলে মার কষ্ট রয়েই গেল! বিচারহীনতায় মা ক্ষুব্ধ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার উপর। এটাই অন্যতম কারন আমাকে সিডনিতে পাঠানোর জন্য!
পৃথিবীর আর কোন দেশে কি সড়ক দুর্ঘটনাতে মানুষের এতো মৃত্যু হয়? আর কোন দেশে কি এতো সহজেই ড্রাইভিং
লাইসেন্স পাওয়া যায়?
মা তো সড়ক দুর্ঘটনার খবর শুরু হলেই টিভির চ্যানেল বদলে দেন। আর এখানে ওভার স্পিড মানেই ফাইন। একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যে কতো কঠিন। খুবই উন্নত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। অনন্ত ভাবে পড়ালেখা শেষ করে মাকেও সিডনিতে নিয়ে আসবে। কতো কি ভাবে অনন্ত। ভাবনার কোন সীমানা নেই! কিন্তু আজ ভাবনায় ভিন্নতা আছে। স্টুডেন্টস ক্যাফেতে বসলে প্রায়শই এগিয়ে আসে এরাব মেয়ে আফরিন। প্রথম দিন পরিচিত যেভাবে হলো তা মনে পড়ে অনন্তর। অনন্ত ব্রেক টাইমে একা একা চুপচাপ বসেছিল ক্যাফেতে। এগিয়ে এসে এরাব লেডি বলে–
– Hey, excuse me?
– Yes, how can i help you?
– I’m on my break time and bored. Can i have a seat with you?
– Yeah sure. No worries.
– Let me first introduce myself.. I’m Afreen from Saudia Arabia, studying bachelor of business. What about you?
– My name is Ananta and I’m studying bachelor of engineering. I’m from Bangladesh.
আর একদিন আফরিন নিজ থেকেই বলেছে– তার পরিবারে বাবা,দুই মা ও নয় ভাইবোনের কথা। এখানে ওরা নিজেদের বাড়ীতে মাকে নিয়ে চার ভাইবোন থাকে ও পড়ালেখা করে। বাবা বছরে দুই তিন বার আসেন। সৌদি রাজ পরিবারের সঙ্গে তাদের আত্মীয়তা আছে।
আর একদিন ক্যাফেতে বসে হঠাৎ করে আফরিন অচেতন হয়ে পড়ে। অনন্ত ট্রিপল জিরো কল করে এম্বুলেন্স এনে হসপিটাল পর্যন্ত গিয়েছিল। সেখানে অবশ্য আফরিনের দুই ভাইবোনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের জীবন যাপন মাত্রা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এভাবেই ঘনিষ্ঠ হয়েছে আফরিন অনন্তর সঙ্গে আর এটাই অনন্তর অস্থিরতার কারন যা মাকেও বলতে পারেনি। আজ ইচ্ছে করে হাইড পার্কে বসে বসে হটাৎ আসা বৃষ্টিতে ভিজলো অনন্ত। অস্থিরতা বৃষ্টির সাথে মিলিয়ে গেলে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে যায়।

হটাৎ দড়জায় নক করে রুমের ভিতরে চলে এলো আফরিন। অনন্ত বিছানায় উঠে বসল চট জলদি। আফরিন পাশে বসেই প্রশ্ন– তোমার যে জ্বর তা জানালে না কেন? তোমার হাউসমেটের নিকট জেনেই চলে আসলাম। রকডেলের এদিকে আমি আগেও এসেছি– এই বলে অনন্তর কপালে হাত রাখে আফরিন।
অনন্ত একটু হেসে চোখদুটো বন্ধ করে একটুখানি। ভাবে কি সৌভাগ্য তার আজ।
বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর না হলে কি আর সে আসতো?
অনন্ত চোখ খুলেই বলল– তুমি আবার কষ্ট করে আসলে কেন?
— কষ্ট করেছি,বেশ করেছি। এই বলে আফরিন তার হিজাব খুলে ফেললো।
নীল জিন্স প্যান্টের সাথে সাদা ধবধবে টি শার্টে এই সজল কালো বড় চোখের মেয়েটিকে অসম্ভব রুপবতী দেখা যাচ্ছে।
চোখদুটোতে এতো মায়া কেন?
— অনন্ত তোমাকে আর একটু কষ্ট করতে হবে। আশা করছি সেই কষ্টটুকু করলে টেম্পারেচার কমে যাবে। এই বলে আফরিন অনন্তর হাত ধরে বিছানা থেকে টেনে তুলছে আর বলছে– চলো শাওয়ার নেবে,নিতেই হবে।
অনন্ত নিঃশেব্দ আফরিনকে অনুসরণ করে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালো।
আফরিন শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে একটু দুরে তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে দেখছে–
একটা বাচ্চা ছেলে যেন খুব কষ্ট করে শাওয়ার নিচ্ছে। তার ঠোঁট দুটো ঠান্ডায় কাঁপছে।
আফরিনের চোখে দুষ্টুমির হাসি। অনন্তর চোখে আনন্দের পানি। অনন্তর এই আনন্দধারা ঝরনাধারায় একাকার হলো।

Tags: