যমুনা নদীর ইতিকথা

মোঃ ইমরান হোসেন আপন, সিরাজগঞ্জ ।। ১৭৮২ থেকে ১৭৮৭ সালের মধ্যে সংঘটিত ভূমিকম্প ও ভয়াবহ বন্যার ফলে ব্রহ্মপুত্রের তৎকালীন গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান কালের যমুনা নদীর সৃষ্টি হয়। বর্ষা ঋতুতে যমুনা নদীর প্রবাহ থাকে বিশাল পরিমাণের এবং গড়ে প্রায় ৪০,০০০ কিউমেক। এই পরিমাণ প্রবাহের দ্বারা নদীটি আমাজন, কঙ্গো, লা প্লাটা, ইয়াংসি, মিসিসিপি এবং মেঘনার পরেই সপ্তম বৃহত্তম স্থানে অবস্থান করে নিয়েছে।
১৯৮৮ সালের আগস্ট মাসে যমুনায় রেকর্ড পরিমাণ প্রবাহ পরিমাপ করা হয় যার পরিমাণ ছিল ৯৮,৬০০ কিউমেক। বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার বার্ষিক গড় প্রবাহ প্রায় ৫০১ মিলিয়ন একর-ফুট। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা বাংলাদেশের দ্বিতীয় এবং বিশ্বের দীর্ঘতম নদীসমূহের মধ্যে অন্যতম। তিববত, চীন, ভারত এবং বাংলাদেশের ভূখন্ড জুড়ে রয়েছে এর অববাহিকা অঞ্চল।

পূর্ব নাম জোনাই নদী, যমুনা বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদীর একটি হলেও পুর্বে মুলত এটি একটি খাল ছিলো (জোনাই খাল) বর্তমানে যা বিশাল আকার ধারণ করেছে। ১৭৮৭ সালের বন্যায় ব্রহ্মপুত্র নতুন খাতে প্রবাহিত হয়ে এই নদীর সৃষ্টি করেছে। যমুনা নদী পদ্মা নদীতে পতিত হয় গোয়ালন্দে (ব্রহ্মপুত্র সাথে) যমুনার প্রবাহমান জেলাসমূহ-বগুড়া জেলা, সিরাজগঞ্জ জেলা, গাইবান্ধা জেলা  উৎপত্তিস্থল- তিব্বতের কৈলাসশৃঙ্গের মানস সরোবর, দৈর্ঘ্য ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) যমুনা নদীর সর্বাধিক প্রস্থ ১২০০ মিটার (আরিচা) যমুনার প্রধান উপনদী গুলো হল তিস্তা, ধরলা, করতোয়া, আত্রাই, সুবর্ণশ্রী (করতোয়া যমুনার দীর্ঘতম এবং বৃহত্তম উপনদী) বাঙালি+যমুনা বগুড়া। বাংলাদেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক নদী পদ্মা এবং ব-দ্বীপের প্রধান নদী পদ্মা, পদ্মা নদী যমুনার সাথে মিলিত হয়েছে গোয়ালন্দ (রাজবাড়ি)। যমুনা নদীপ্রণালী দেশে উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত সর্বাধিক প্রশস্ত নদীপ্রণালী। বাহাদুরাবাদে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদের প্রবাহ রেকর্ড করা হয়ে থাকে।ব্রহ্মপুত্র-যমুনার চারটি প্রধান উপনদী রয়েছে: দুধকুমার, ধরলা, তিস্তা এবং করতোয়া-আত্রাই নদীপ্রণালী। এদের মধ্যে দুধকুমার, ধরলা এবং তিস্তা নদী তিনটি খরস্রোতা প্রকৃতির এবং ভারতের দার্জিলিং ও ভূটানের মধ্যবর্তী হিমালয়ের দক্ষিণপার্শ্বে অত্যধিক ঢালবিশিষ্ট অববাহিকা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। শাখানদীসমূহের মধ্যে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র দীর্ঘতম এবং দুইশত বছর পূর্বে এটিই ছিল ব্রহ্মপুত্রের মূল গতিধারা।
যমুনা নদীর ইতিহাস-
ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে উদ্ভূত যমুনা নদী একটি braided river. এর অর্থ হলো, যমুনা একটি নদী নয় বরং একগুচ্ছ নদীর সমাহার (synchronization). ১৭৮৭ সালের আগে, যমুনার বুকে কোনো নদী ছিলো না। জোনাই খাল নামে একটি ছোট্ট স্রোতধারা ছিলো। খালটিকেই কোন কোন এলাকায় যমুনা বলে ডাকা হত বলে কতিপয় ঐতিহাসিকের দাবি। ১৭৬২ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদের মূলস্রোত পরিবর্তিত হয়ে এই খালটির ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে। নাম হয় যমুনা। ১৭৮৭ সালে আরেকটি বড় বন্যায় তিস্তা নদীর একটি বড় স্রোত যমুনায় যোগ দেয়। ফলে, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, জোনাই খাল সবগুলোর স্রোত মিলে সুবিশাল নদী হিসেবে যমুনার আবির্ভাব ঘটে।
আমাদের যমুনার কিছু বৈশিষ্ট্য-
তিববতের মানস সরোবর এবং কৈলাস পর্বতের মধ্যবর্তী পার্খা নামক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র থেকে ১৪৫ কিমি অদূরে অবস্থিত চেমায়ুং-দুং নামক হিমবাহ (৩১°৩০´ উত্তর এবং ৮০°২০´ পূ) থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তি। সুবিশাল বঙ্গীয় সমভূমিতে পতিত হওয়ার পূর্বে আসামে ব্রহ্মপুত্র নদ ডিহাং নামে অভিহিত। কুড়িগ্রাম জেলার মধ্য দিয়ে এটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। গঙ্গা নদীর সঙ্গে সঙ্গমের পূর্ব পর্যন্ত সাংপো-ব্রহ্মপুত্র-যমুনার সম্মিলিত দৈর্ঘ্য প্রায় ২,৭০০ কিমি। বাংলাদেশ ভূখন্ডে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার দৈর্ঘ্য ২৭৬ কিমি যার মধ্যে যমুনা নদীর দৈর্ঘ্য ২০৫ কি.মি। ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল যমুনা নদী এবং বাংলাদেশের নদীগুলোর মদ্ধে চরের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি আমাদের এই যমুনায়।আগস্ট মাসে প্রায়ই ব্যাপক বিস্তৃত বন্যা সংঘটিত হয়ে থাকে। মে মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সংঘটিত বন্যা ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং মেঘনা নদীতে প্রবাহ বৃদ্ধির কারণে সংঘটিত হয়ে থাকে। গঙ্গার তুলনায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর প্রবাহ অধিকতর গতিসম্পন্ন। যমুনার গড় নতিমাত্রা ১:১১,৮৫০, গঙ্গার নতিমাত্রার তুলনায় সামান্য বেশি। বিশাল আয়তনের জলরাশি প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে যমুনা প্রচুর পরিমাণে পলিরাশিও বহন করে থাকে। বর্ষা ঋতুতে যমুনা নদী দৈনিক প্রায় ১২ লক্ষ টন পলি বহন করে আনে এবং বাহাদুরাবাদে পরিমাপকৃত যমুনার বার্ষিক পলিবহন ক্ষমতা প্রায় ৭৩৫ মিলিয়ন টন। পাশাপাশি দুই রঙের পানির স্রোত পাওয়া যায় এই নদীতেই।
বাংলাদেশে বড় বড় নদীর চ্যানেলগুলির ক্রমস্থানান্তর বা পরিবর্তন বছরে ৬০ মিটার থেকে ১৬০০ মিটারের মধ্যে হতে পারে। কোনো বিশেষ বছরে প্রায় ২৪০০ কিঃমিঃ তটরেখা জুড়ে ব্যাপক ভাঙন ঘটতে পারে, যমুনা এরমধ্যে অন্যতম। যমুনা নদী যমুনা একটি বিনুনি আকৃতির নদী যার তীরের উপাদানসমূহ ভাঙনের পক্ষে খুবই সংবেদনশীল।
অনেকগুলো স্রোত পাশাপাশি- কাছাকাছি এসে মিলিত হলেও যমুনা কখনো একক স্রোতে প্রবাহিত হয় নি। বরং, অনেকগুলো ছোট ছোট স্রোত একটা গুচ্ছে সন্নিবিষ্ট হয়ে হাত ধরাধরি করে এক পথে চলতে থাকে। যমুনা নদী দ্বারা বিভক্ত বাংলাদেশের পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চলকে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে যমুনা নদীর উপর সাম্প্রতিক কালে ৪.৮ কিমি দীর্ঘ একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতু নামে অভিহিত এই সেতুর পূর্ব প্রান্ত টাঙ্গাইল জেলার ভূয়াপুর উপজেলায় এবং পশ্চিম প্রান্ত সিরাজগঞ্জ জেলার সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলায় অবস্থিত। সেতুতে বিদ্যমান সড়ক ও রেলপথে যাত্রী ও পণ্যের দ্রুত পরিবহণ ছাড়াও সেতুর মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক গ্যাসের সঞ্চালন এবং টেলিযোগাযোগ ত্বরান্বিত হয়েছে। সেতুটি ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। অত্যধিক প্রচরণশীল যমুনা নদীকে সেতু দ্বারা নির্ধারিত খাতে প্রবাহমান রাখার জন্য ব্যাপক নদীশাসন কর্মকান্ড সম্পন্ন করা হয়।
১৯১৪ সালে যমুনা নদীর রেকর্ডকৃত নিম্নতম গড় প্রস্থ ছিল ৫.৬ কিমি। স্থানীয় পর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রস্থ ১৫ কিমি ছাড়িয়ে যায় এবং সর্বনিম্ন স্থানীয় প্রস্থ প্রায় ১.১ কিমি সীমিত ছিল। ১৯৭৩-২০০০ সময়কালে নদীটির প্রশস্ত হওয়ার হার বছরে ১২৮ মিটার (বাম তীরে ৬৮ মিটার ও দক্ষিণ তীরে ৬০ মিটার)। ১৯৮৪-৯২ সময়কালে প্রশস্তায়নের বাৎসরিক হার বেড়ে ১৮৪ মিটারে দাঁড়ায় যার মধ্যে বাম তীরে ১০০ মিটার ও দক্ষিণ তীর বরাবর ৮৪ মিটার (সারণি-১)। এ সময়কালে নদীর গড় প্রস্থ ৯.৭ থেকে ১১.২ কিমি বৃদ্ধি পেয়েছে (সারণি-২)। ১৯৮৪-৯২ সময়কালে সর্বোচ্চ তীর ভাঙনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে পূর্ব তীরে, আরিচার ঠিক উজানে। ১৯৭৩ সাল থেকে ৯০-এর দশকের প্রথম পর্যন্ত যমুনা নদী ক্রমাগত চওড়া হতে থাকে। কিন্তু ৯০-দশকের শেষের দিকে চওড়া হওয়ার এ বাৎসরিক হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। বিগত ২৮ বছর সময়কালে নদীর এ প্রশস্তায়নের ফলে নদীটির ২২০ কিমি দীর্ঘ বাংলাদেশ অংশে ৭০,০০০ হেক্টর প্লাবনভূমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে (গড়ে বছরে প্রায় ২,৬০০ হেক্টর) ১৯৮৪-৯২ সময়কালের মধ্যে যমুনা নদীর ৪০,১৫০ হেক্টর প্লাবনভূমি হ্রাস পেয়েছে এবং ৭,১৪০ হেক্টর উপলেপিত হয়েছে বা জেগে উঠেছে, যার হার বাৎসরিক হিসাবে দাঁড়ায় ভাঙন প্রায় ৫০০০ হেক্টর আর উপলেপ (accretion) প্রায় ৯০০ হেক্টর।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে যমুনা নদীতে মানুষের কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু যমুনা বাঁধ নির্মাণ, সিরাজগঞ্জ, সারিয়াকান্দি ও বাহাদুরাবাদে নদী প্রতিরক্ষা কাঠামো ইত্যাদি যমুনা নদীর প্রস্থের পরিবর্তনে নিঃসন্দেহে প্রভাব ফেলবে। এসব নির্মাণ ও পরিকাঠামো তীর ভাঙনের মাধ্যমে নদীর প্রশস্ত হওয়ার প্রবণতা সংকুচিত করছে।
 Related image
১৯৯২ সালের শুষ্ক ঋতুতে তোলা ল্যান্ডস্যাট ইমেজ (Landsat image) থেকে দেখা যায় যমুনা নদীতে ৫৬টি বৃহদাকৃতির দ্বীপ বা চর বিদ্যমান রয়েছে যাদের প্রতিটি ৩.৫ কিমি-এর অধিক দীর্ঘ। বালুময় চর এবং উদ্ভিদ আচ্ছাদিত চরও এই হিসাবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র মুখের বিপরীত প্রবাহে, সিরাজগঞ্জের উত্তর ও পূর্ব পার্শ্বে এবং গঙ্গার সঙ্গে মিলনস্থলের উজানে যমুনার দক্ষিণতম প্রবাহে নিয়মিত চর গঠন প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হয়েছে। বিভিন্ন নদীর তীর ভাঙনের কবলে পড়ে ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯৩ সালের মধ্যে প্রায় ৭,২৯,০০০ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ছিল যমুনার তীর ভাঙনের শিকার। বলতে গেলে যমুনা নদীর সৃষ্টি হয়েছে জন্যই ‘সিরাজগঞ্জ’ জেলার সৃষ্টি হয়েছে। সিরাজগঞ্জ বন্দরের উদ্ভব ও এর বিকাশের মূলে রয়েছে যমুনা। যমুনা সেতু ও আধুনিক সিরাজগঞ্জ জেলার সৃষ্টিতে যমুনা নদী ও যমুনা সেতুর ভূমিকাই মূখ্য।

আরও পড়ুন

1 Comment

  1. I simply want to tell you that I’m very new to blogging and site-building and honestly enjoyed this web blog. Very likely I’m planning to bookmark your blog . You surely have impressive posts. Regards for sharing with us your blog.

Comments are closed.