muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

কিশোরগঞ্জের খবর

কিশোরগঞ্জ-৫ : আ.লীগের দ্বন্দ্বে সুবিধায় বিএনপি

হাওর এলাকার প্রবেশদ্বার বলে খ্যাত সংসদীয় আসন কিশোরগঞ্জ-৫। বাজিতপুর উপজেলার একটি পৌরসভাসহ ১১টি ইউনিয়ন ও নিকলী উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ আসন। এই দুই উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৩ লাখের মত ভোটার রয়েছে।

‘বাজিতপুর সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনায়েম খানের এলাকা। মুসলিম লীগের তথা ডানপন্থিদের বড় সমর্থক শ্রেণী থাকায় স্বাধীন বাংলাদেশেও তার ছেলে খালেকুজ্জামান খান হুমায়ূন এ আসনের সংসদ সদস্য হন। সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানও একবার অখ্যাত প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে পরাজিত হন মূলত স্থানীয় রাজনীতির মেরুকরণ ও আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে’।

স্হানীয় এক নেতার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আওয়ামীবিরোধী ভোটের দাপটে প্রয়াত মজিবুর রহমান মঞ্জু বিএনপি থেকে দুইবার সংসদ সদস্য হন, যদিও তাকে কেউ ভালো করে চিনতেনই না’। তিনি বলেন, ‘নিকলীর ভোট কম। কিন্তু একাট্টা হয়ে ভোট দেয় নিকলী। রাজনীতি ও আঞ্চলিকতার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ কোন্দলও স্থানীয় রাজনীতি ও ভোটের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু’।

স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় ৩৩ বছর বিএনপি ও মুসলিম লীগ প্রার্থীরা আসনটিতে রাজত্ব করেছেন। তবে ১৯৭২ সালে মাত্র একবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক এমপি মঞ্জুর আহম্মেদ বাচ্চু মিয়া বিজয়ী হয়েছিলেন। ৩৩ বছর পর ২০০৮ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে বিএনপির দুই বারের প্রয়াত এমপি আলহাজ্ব মুজিবুর রহমান মঞ্জুকে ৫৮ হাজার ৩ শত ২৫ ভোটে পরাজিত করে বিজয়ী হন আলহাজ্ব মো. আফজাল হোসেন। আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি আফজাল হোসেন ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে দলকে অনেকটাই গুছিয়ে এনেছেন। অন্যদিকে, ক্ষমতার বাইরে থাকলেও পিছিয়ে নেই বিএনপিও। তবে এ আসনে দুই দলের বিরুদ্ধেই নানা দুর্নাম রয়েছে।

আগামী নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা হচ্ছেন বর্তমান এমপি আলহাজ্ব মো. আফজাল হোসেন, প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ মো. আলাউল হক, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অজয় কর খোকন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জেলা আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট শেখ নুরুন্নবী বাদল, আওয়ামীলীগ নেতা প্রয়াত এড. আব্দুল লতিফের ছেলে ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিল্টন, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগ নেতা আবুল মনসুর বাদল, আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপ কমিটির সদস্য শহীদুল্লাহ মুহাম্মদ শাহ নূর ও সাংবাদিক ফারুক আহম্মদ।

ঐতিহ্যের দিক থেকে ১৮৬৯ সালে বাজিতপুর পৌরসভায় উন্নীত হয়। তারপর পূর্বের ছয় থানা ও বর্তমানে ৫ উপজেলা নিয়ে দেওয়ানী চৌকি আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। যে কারণে বাজিতপুরকে জেলার দাবি এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি। যা অধরাই রয়ে গেছে আজ পর্যন্ত।

এদিকে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর-নিকলী) আসনের আওয়ামীলীগ ও বিএনপির নবীণ-প্রবীন প্রার্থীরা রয়েছেন মনোনয়ন দৌড়ঝাঁপ প্রতিযোগিতায়। বর্তমানে এক ডজন মনোনয়ন প্রত্যাশী ও তার সমর্থকরা বাজিতপুর ও নিকলীর গ্রাম-গঞ্জ, প্রত্যন্ত অঞ্চল চষে বেড়াচ্ছেন। মাঠে-ময়দানে প্রচার-প্রচারণা ও জনসংযোগ এবং মনোনয়ন পেতে ঢাকায় লবিং করছেন নানাভাবে। হাটে-বাজারে চায়ের কাপে ঝড় তুলছে নির্বাচনকেন্দ্রিক আলোচনা। নির্বাচনকে ঘিরে এখানে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কে হবে আগামী দিনের কাণ্ডারি?

আসনটির একাধিক সিনিয়র নেতার মতে, ‘বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ বেশি সঙ্কটে রয়েছে। বর্তমান সংসদ সদস্য আফজাল হোসেনের সঙ্গে দলের দূরত্ব ও বিরোধ তুঙ্গে। তার সঙ্গে বাজিতপুর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি দুর্দিনের কাণ্ডারি মিসবাহউদ্দিন আহমদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিরোধ শক্তি প্রয়োগ ও মামলাবাজিতে গড়ায়। এ দ্বন্দ্ব-সংঘাত আওয়ামী লীগের বিপদ ডেকে আনছে, সুবিধা পাচ্ছে বিএনপি’। গত পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ মেয়র প্রার্থী দিতে পারেনি। সংসদ সদস্যের সঙ্গে দলের অনেকের বিরোধ সংঘর্ষের পর্যায়েও গড়ায়। গ্রুপিং-কোন্দলে বেশি ব্যস্ত থাকায় তার ইমেজ সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে’। ‘আওয়ামী লীগের অন্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা এ সুযোগে নিজেদেরকে স্বচ্ছভাবে তুলে ধরে ও ব্যাপক গণসংযোগ করে এগিয়ে গেছেন’।

অপরদিকে বিএনপিতে চাপা দলাদলি থাকলেও প্রকাশ্য ও তীব্র দ্বন্দ্ব নেই। নিজেদের পকেট এলাকাগুলোতে ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে কাজ করছেন মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। আপাতত কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য সামনে না এনে এ প্রচার কৌশলে অঞ্চল ও ভোট ব্যাঙ্ক গড়ার চেষ্টাই বেশি লক্ষ্যণীয়। ভোটারদেরকে প্রণোদিত করতে একই এলাকায় একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী গিয়ে অভিন্ন ম্যাসেজ দিচ্ছেন যে, ‘আগামী নির্বাচনে জেতার জন্য সবাই একযোগে কাজ করুন’। তাদের সমর্থকরাও মাঠে সরব ও তৎপর।

‘নিজেদের স্বার্থেই ঐক্যবদ্ধ বিএনপি। দল যাকে মনোনয়ন দেবে, মোটামুটিভাবে সবাই তার হয়েই কাজ করবেন’ বলে বিশ্বাস করেন বিএনপির একাধিক নেতা।

আরও কয়েকজনের ভাষায়, ‘বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা সবাই সম্ভাবনাময় ও শক্তি-সামর্থ্যে সমানে সমান। শেষ পর্যন্ত যিনি মনোনয়ন পাবেন, বিএনপিপন্থি ভোটারদের সমর্থন সেদিকেই হেলে যাবে’।

আওয়ামী লীগের কয়েক নেতা জানান, আফজাল হোসেন এমপি হওয়ার পর ক্ষমতার জোরে দলের বাজিতপুর উপজেলা আহ্বায়ক হন। এ সময় পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে তার ভাই আশরাফ হোসেনকে জয়ী করার জন্য ভোটকেন্দ্র দখল করা হয়, সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হয়। এই এমপির সায় না থাকলে থানায় মামলাও করা যায় না। স্থানীয় প্রশাসন চলে না। বর্তমান এমপির এই ধরনের অপকর্মের জবাব দেওয়ার জন্য ভোটাররা প্রস্তুত হয়ে আছেন।

এদিকে আফজাল সমর্থকরা বলেন, আবারও আফজাল হোসেন দলের মনোনয়ন পাবেন। জনপ্রিয় হওয়ায় তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের পাশাপাশি দলের কয়েকজন নেতা অকারণেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে মিথ্যাচার করছেন। দলের দুঃসময়ে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাংগঠনিক কাজ করেছেন। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর দলকে আরও সংগঠিত ও শক্তিশালী করেছেন। তার সময়ে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজও হয়েছে।

সব মিলিয়ে রাজনৈতিক বিন্যাস অনুসারে ভোটের প্রচার-প্রচারণা ও মেরুকরণ ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে। ব্যাপক জনসংযোগের পাশাপাশি চলছে কোটারি ভিত্তিক প্রকাশ্য ও গোপন বোঝাপড়া। বড় ধরনের রাজনৈতিক চাঞ্চল্য সৃষ্টির সব লক্ষণই প্রকাশ পাচ্ছে ভোটের মাঠে-ময়দানে।

১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) আলাউল হক। নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনেও তিনি দলের মনোনয়ন চাইবেন। দলের নীতিনির্ধারকরা তাকেই মনোনয়ন দেবেন বলে প্রত্যাশা করছেন তিনি।

দলের বাজিতপুর উপজেলা শাখার সাবেক আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট শেখ একেএম নুরুন্নবী বাদল জানান, ক্ষমতা মানুষকে কতটা স্বেচ্ছাচারী করে তুলতে পারে, তা এ আসনের নাগরিকরা টের পাচ্ছেন। কিন্তু কথিত প্রভাবশালীদের ভয়ে কেউই মুখ খুলছেন না। এ অবস্থায় তিনি দলে জবাবদিহি ফিরিয়ে আনা এবং প্রকৃত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম করছেন। আম-জনতার প্রতিনিধি হিসেবে দল আগামী নির্বাচনে তাকেই মনোনয়ন দেবে বলে তিনি মনে করছেন।

২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চেয়েও ব্যর্থ হয়েছিলেন অজয় কর খোকন। তিনি প্রত্যাশা করছেন, এবার দল তাকে মনোনয়ন দেবে।

আবুল মনসুর বাদল বলেন, তিনি ২০০৮ সালে দলীয় মনোনয়ন চেয়েও পাননি। এবার তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদের পরামর্শ নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।

এ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে স্টার তালিকায় রয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান ইকবাল। এছাড়াও রয়েছেন বাজিতপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র এহেসান কুফিয়া, সাবেক এমপি আমির উদ্দিন আহমেদের ছেলে অ্যাডভোকেট বদরুল আলম মিঠু, সাবেক এমপি মজিবুর রহমান মঞ্জুর ছেলে মাহমুদুর রহমান উজ্জ্বল, সাবেক এমপি খালেকুজ্জামানের চাচাতো ভাই ছালেহুজ্জামান খান রুনু, কেন্দ্রীয় শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক তফাজ্জল হোসেন বাদল, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ইশতিয়াক আহমেদ নাসির, ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক শফিকুল আলম রাজন।

শেখ মুজিবুর রহমান ইকবাল বলেন, বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসনে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের আগে নির্বাচিত হতে পারেনি। তারা সব নির্বাচনেই ১০-২০ হাজার ভোটে পিছিয়ে থাকে। গত উপজেলা এবং পৌরসভা নির্বাচনেও বিএনপির প্রার্থীই বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান সরকার ভোট ডাকাতি করে তাদের বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে। তবে আগামী নির্বাচনে জনগণের ভোটের অধিকার আর কেড়ে নিতে দেওয়া হবে না। তিনি দলের মনোনয়ন চাইছেন।

তবে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী শফিকুল আলম রাজন বলেন, দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের কেউই সম্ভাব্য প্রার্থী শেখ মুজিবুর রহমান ইকবালকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে দেখতে চাইছেন না।

দলের জেলা সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম বলেন, বাজিতপুর ও নিকলীর মানুষ ক্ষমতাসীনদের অত্যাচার ও নির্যাতন প্রত্যক্ষ করেছে। তারা আগামী নির্বাচনে বিএনপিকেই বেছে নেবে।

এহেসান কুফিয়া জানান, নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তিনি তৃণমূলে কাজ করছেন। উঠান বৈঠক করছেন। নেতাকর্মীদের সঙ্গেও নিবিড় যোগাযোগ রাখছেন। মনোনয়ন পেলে তিনি নির্বাচিত হবেন।

দলের নিকলী উপজেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট বদরুল আলম মিঠু বলেন, তার বাবা এই আসনে তিনবারের সাবেক এমপি। তাই আসনটি পুনরুদ্ধার করতে বাবার উত্তরসূরি হিসেবে দল তাকে মূল্যায়ন করবে বলে তিনি আশা করছেন।

দলের জেলা সদস্য মাহমুদুর রহমান উজ্জ্বল জানান, তার বাবা দুইবারের সাবেক এমপি। বাজিতপুর ও নিকলীতে তার বাবার বহু সমর্থক রয়েছেন। তারাই তাকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চাইছেন। এ ক্ষেত্রে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাকে হতাশ করবেন না বলে তিনি মনে করছেন।

অন্যদিকে হয়ে জামায়াতের প্রবীন রাজনীতিবিদ জেলা জামাতের সেক্রেটারী অধ্যাপক রমজান আলী ও মাঠে রয়েছে। যদিও বামদের দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য ঘেরা এই আসনে নির্বাচনী মাঠে কারো নাম শোনা যাচ্ছে না। তবে বামদের রয়েছে উল্লেখযোগ্য প্রভাব। নির্বাচনে তারা যেদিকে মোড় নেয় সেদিকেই জয়ের পাল্লা ভারী থাকে।

Tags: