muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

কটিয়াদী

বিলুপ্তির পথে বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পৈত্রিক বাড়ি

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার ছোট্ট একটি গ্রাম মসুয়া। বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পৈত্রিক ও শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের ঐতিহাসিক বাড়ি কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে। এ বাড়িতে রয়েছে একটি পুকুর ও শান বাঁধানো ঘাট। পশ্চিম দিকে রয়েছে কয়েক একর জায়গাজুড়ে বাড়ি। পূর্বে প্রাচীর ও সিংহ দরজা ছিল যা এখন বিলুপ্ত। পশ্চিমে জরাজীর্ণ ভবন, এখন যেটি ভূমি অফিস নামে পরিচিত। তার একটু পশ্চিমে গেলেই ডাকঘর। বাড়ির ভিতরে রয়েছে কারুকার্যখচিত প্রাচীন দালান, বাগানবাড়ি, হাতির পুকুর, খেলার মাঠ ইত্যাদি। যে বাড়িতে সত্যজিৎ রায়ের এত ঐতিহ্য, সেই বাড়িটি এখন ধ্বংসের পথে। দেখার যেন কেউ নেই।

সত্যজিৎ রায়ের পিতামোহের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি এখন সরকারের রাজস্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে আছে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের উদ্যোগে ২০১২ সালে ৫৯ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি রেস্ট হাউজসহ বাড়ির সীমানা প্রাচীর ও রাস্তাঘাট সংস্কার করা হয়। যেটি এখন কোনো কাজেই আসছে না। এই বাড়িতে ১৮৬০ সালের ১২ মে জন্মগ্রহণ করেন সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী। তিনি ছিলেন বিখ্যাত শিশুকিশোর পত্রিকা ‘সন্দেশ’র (১৯১৩) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তার বাবার নাম ছিল কালীনাথ রায়। পাঁচ বছর বয়সে নিঃসন্তান চাচা হরিকিশোর রায় চৌধুরী তাকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। পিতার দেওয়া কামদারঞ্জন রায় নাম বদলিয়ে রাখেন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী। কিন্তু দত্তক পুত্র গ্রহণের বেশ কয়েকবছর পর হরিকিশোর রায় চৌধুরী ওরফে নরেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী জন্মগ্রহণ করায় দত্তক পুত্র উপেন্দ্র কিশোরের গুরুত্ব কমতে থাকে। হরিকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন জমিদার।

তার স্নেহে লালিত উপেন্দ্রকিশোর ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে ১৮৮০ সালে প্রবেশিকা এবং কলকাতা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউট থেকে বিএ পাস করেন। এদিকে, হরিকিশোর রায় চৌধুরী ভবিষ্যতে সম্পদের উত্তরাধীকার নিয়ে ঔরসজাত পুত্র ও দত্তক পুত্রের মাঝে যাতে কোনো সংঘাত না বাধে সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এ জন্য বাড়ির চার দেয়ালের বাইরে নকশা করে লোহার খুঁটি দিয়ে দত্তক পুত্রের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা বাড়ির সীমানা নির্ধারণ করে দেন। লোহার খুঁটিগুলো আজও রয়েছে। সীমানা নির্ধারিত বাড়িতে উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ঔরসে ১৮৮৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন জ্যেষ্ঠ পুত্র সত্যজিৎ রায়ের পিতা শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়। জন্মের পরই সুকুমার রায়সহ উপেন্দ্রকিশোর চলে যান কলকাতায়। মাঝে মাঝে নিজ বাড়িতে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বেড়াতে আসতেন তিনি। তার মেজো মেয়ে পুণ্যলতার অনেক সাহিত্যকর্মের মধ্যে ছেলেবেলার দিনগুলোতে সেকালের মসুয়ার বর্ণাঢ্য রায় চৌধুরী পরিবারের বিবরণী রয়েছে। হরিকিশোর রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার পুত্র নরেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী মসুয়ায় জমিদারী লাভ করেন। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী হয়ে পড়েন কলকাতা কেন্দ্রিক। নাতি সত্যজিৎ রায়ের জন্ম কলকাতাতেই এবং বেড়ে ওঠাও কলকাতাতেই। মসুয়া গ্রামের সত্যজিৎ রায়ের সেই ঐতিহাসিক পৈতৃক ভিটেমাটি ও স্মৃতিচিহ্ন এখন বিলুপ্তির পথে।

ভাঙাচোরা এই বাড়িটি দিন দিন ধ্বংস হচ্ছে। বাড়িটি রাজস্ব বিভাগের দখলে থাকলেও বহু জায়গা বেদখল হয়ে গেছে। অস্কার বিজয়ী বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ঐতিহাসিক পৈতৃক বাড়িকে একসময় বলা হতো ‘পূর্ব বাংলার জোড়াসাঁকো’। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শেষ বুধবার এ ঐতিহাসিক বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় বৈশাখী মেলা। মসুয়া গ্রামে সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের স্মৃতি চিহ্নটুকু ধরে রাখার জন্য গঠিত হয়েছে সত্যজিৎ রায় স্মৃতি সংসদ। প্রতি বছর ৫ মে পালন করা হয় সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিবস। প্রতিদিন বহু দর্শনার্থী সাহিত্যিক-কবি বাড়িটি পরিদর্শনে আসেন। নতুন প্রজন্মকে সত্যজিৎ রায়ের ইতিহাস কিংবা স্থানীয় প্রশাসনকে নিজস্ব উদ্যোগ নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরে পর্যটন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

Tags: