muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

মুক্তিযোদ্ধার কথা

কোহিনুর ভিলায় এক রাতে শহীদ হয়েছিলেন ১৬ জন

১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভয়াল রাত। সারাদেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। কুষ্টিয়া শহরের রজব আলী খান লেন। বাড়ির নম্বর ৪০/১৯। একতলা পুরাতন দালান বাড়ি। দেখতে কিছুটা স্কুল ঘরের মতো লম্বা। বাড়ির মালিকের নাম রবিউল হক। বেকারির ব্যবসা করতেন। মায়ের নামে বাড়িটির নাম রেখেছিলেন- কোহিনূর ভিলা। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাড়িটিকে নিরাপদ ভেবে তাঁর দুই ভাই পরিবারসহ এখানে থেকে যান।  আশেপাশের বিহারীরা আশ্বাস দিয়েছিলেন- কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু ঘটল উল্টো। অভিযোগ, গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের পাউরুটি ও বিস্কুট সরবরাহ করা।

কুষ্টিয়া শহরের ঘৃণীত রাজাকার মজিদ কসাই, ফোকু কসাই ও কোরবান বিহারীর নেতৃত্বে পঁচিশ ত্রিশজন রাজাকার ও বিহারী মিলে জোট বেঁধে কোহিনূর ভিলায় প্রবেশ করে। তখন মাঝরাত। সবাই ঘুমে। বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলে। বাড়ির সব সদস্যকে ধরে এনে জড়ো করে বাড়ির পেছন দিকের একটি কক্ষে। বাড়ির ছাদে উঠে মাইক বাঁধে। উচ্চস্বরে বাজাতে থাকে পাকিস্তানি উর্দু গান। বাইরের মানুষ ভাবে হয়তো কোনো অনুষ্ঠান বা পিকনিক চলছে। প্রথমে গৃহকর্তার আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে রিজিয়াকে হত্যা করা হয়। রিজিয়ার পেটে থাকা সন্তানকেও পেট কেটে বের করে তারপর তাকে মেরে ফেলা হয়। তারপর একে একে রান্নাঘরে একটি কাঠের গুঁড়ির ওপর সবাইকে নিয়ে আসা হয়। তলোয়ার দিয়ে বাড়ির গৃহকর্তা রবিউল হক, তাঁর স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, নাতি-নাতনিসহ তিন প্রজন্মের ১৬ জনকে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। বাড়ির সরু ড্রেনে স্রোতের মত গড়াতে থাকে বৃদ্ধ থেকে শিশুর রক্ত। মাইকের উচ্চ শব্দের কারণে প্রতিবেশীদের কেউ বুঝতে পারেনি ভেতরে কী ভয়াবহ নৃশংস ঘটনা ঘটছে। ওই রাতের নির্মম হত্যাযজ্ঞে শহীদ হন গৃহকর্তা রবিউল হক (৬০), তাঁর দুই স্ত্রী, ভাই আরশাদ আলী (৫০), তাঁর স্ত্রী বেগম আরশাদ (৩৮), ছেলে আব্দুল মান্নান (২২), আব্দুল হান্নান (২০), মেয়ে রিজিয়া (২৮), ভাইয়ের মেয়ে বাতাসী (১৮), জরিনা (১৪), ভাই আনু (১৮), বোন আফরোজা (৪০), ভাই আশরাফ (৩০), আসাদ (২৫), এ ছাড়াও দুই নাতি রেজাউল (১০) ও রাজু (৮)। সকালে পৌরসভার ড্রেনে রক্ত দেখে এলাকাবাসী এসে ক্ষত-বিক্ষত লাশ দেখতে পায়। পরে স্থানীয়রা বাড়ির পেছনে লাশগুলো একত্রে কবর দেয়ার ব্যবস্থা করেন।

কোহিনূর ভিলার দুই-তিন বাড়ির পর মোশারফ হোসেনের বাড়ি। তিনি এলাকার সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি। তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘রাজাকাররা কোহিনূর ভিলায় ঢুকে বাড়ির সবাইকে জবাই করেছিল। কোহিনূর ভিলার মালিক রবিউল বেকারির ব্যবসা করতেন। তাঁর কাছে ওই সময় বেশ কিছু টাকাও ছিল। খুনিরা টাকা ছাড়াও বাড়ির মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। রবিউলের পরিবার ছাড়াও আত্মীয়স্বজন সবাইকে হত্যা করার ফলে কোহিনূর ভিলা বিরাণভূমিতে পরিণত হয়। বাংলাদেশে রবিউলের আর কোনো স্বজন ছিল না। দেশ স্বাধীন হলে আমি ভারতের হুগলিতে খবর পাঠাই। সেখানে রবিউলের ভাই থাকতেন। ভাই ইসমাইল খবর পেয়ে কোহিনূর ভিলায় এসে আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা করেন (কালের কণ্ঠ, ১ ডিসেম্বর, ২০১৫)’।

সেই ইসমাইল মল্লিকও মারা গেছেন। এখন বাড়িটিতে ইসমাইলের ছেলে মো. হালিম মল্লিক, শিরু মল্লিক (ডালিম), মেয়ে আকলিমা খাতুন বাস করছেন। ২০১০ সালের ৩১ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে বাড়িটিতে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম এটি নির্মাণ করে। সংগঠনের খুলনা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক লে. গাজী রহমত উল্লাহ দাদু (অবসরপ্রাপ্ত) বীরপ্রতীক নামে স্মৃতিফলকটি উদ্বোধন করেন। বর্তমান বাড়ির সদস্য শিরু মল্লিক (ডালিম) বললেন, ‘৭১ সালের ভয়াবহ এই ঘটনা বড় হয়ে আমি জানতে পেরেছি। এই স্মৃতিফলক ছাড়া আমাদের আর কিছুই নেই। স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা শহীদ পরিবারের মর্যাদা পাইনি। ১৮ সেপ্টেম্বর এলে আমরা বাড়ির পেছনে গণ কবরের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করি। চোখের পানি ফেলি। জানার চেষ্টা করি- কত দাম দিয়ে কেনা এই বাংলা।’

বাড়ির বড় ছেলে মো. হালিম মল্লিক জানান, আমি বিশ বছর ধরে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। এই বাড়িটি সংস্কার করা প্রয়োজন। বাড়ির পুরাতন সবকিছু ভেঙে নষ্ট হয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত আমরা শহীদ পরিবারের মর্যাদা পাইনি। সরকারি বা বেসরকারিভাবে আমাদের সহযোগিতা করা হয়নি যা দিয়ে এই বাড়ির স্মৃতি ধরে রাখবো। প্রতিবছর ১৮ সেপ্টেম্বর আমরা পারিবারিকভাবে দোয়ার আয়োজন করি। কবর পরিষ্কার করি। চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না।

কুষ্টিয়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার ও কুষ্টিয়া সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি রফিকুল আলম টুকু বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে বাড়ির মালিক রবিউল হককে চিনতাম। বাড়ির সবাইকে হত্যা করার ফলে পরিবারের কোনো সদস্য না থাকায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদে শহীদ পরিবারের মর্যাদা পাওয়ার জন্য কেউ আসেনি। কোহিনূর ভিলার ঘটনাটি খুবই ভয়াবহ ও স্পর্শকাতর। এখন ওই বাড়িতে তার ভাইয়ের ছেলেরা বাস করে। পরিবারের কেউ যোগাযোগ করলে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করব।

Tags: