
ডাকাত সর্দার বসুর বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠার কাহিনী
এমন ঘটনা অনেক আছে। অনেকেই ডাকাত থেকে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। তবে এই ঘটনার সঙ্গে অন্যগুলোর পার্থক্য অনেক। আমি লিখছি ‘বসুবাহিনী’র কথা। হাওর অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বাহিনীটি গড়ে তুলেছিলেন বসু নামের এক ডাকাত। তবে কোনো কাজই তিনি সহজে করতে পারেন নি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম লেখাতে পারেন নি। এমনকি ভারতে ট্রেনিং নেয়ার সুযোগও তাকে দেওয়া হয়নি।
দেশের জন্য ভালোবাসা থাকলে, অসম্ভব বলতে কিছুই থাকে না। কোনো স্বীকৃতি বা প্রশিক্ষণের অপেক্ষায় বসে থাকেননি বসু। তিনি দেশের জন্য নিজেকে সমর্পণ করলেন রণক্ষেত্রে।
কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলের নিকলী উপজেলার গুরুই গ্রামে গড়ে উঠে দুর্র্ধর্ষ ডাকাত আব্দুল মোতালেব বসুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল বসুবাহিনী। পরবর্তীতে বসুর এই বাহিনী কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলার হাওরাঞ্চলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুলে। ১৯৭১ সালে বসুবাহিনী হাওরাঞ্চলে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে, বসুবাহিনীর প্রতিষ্ঠিত মুক্তাঞ্চলে তখন থেকেই আশ্রয় নিতে থাকে হাজার হাজার মানুষ।
উত্থান
হাওরের এক দুর্ধর্ষ ডাকাত হিসেবে আবদুল মোতালেব বসু ওরফে ভর্সা ডাকাতের খুব নামডাক ছিল আগে থেকেই। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে বসু ডাকাত একটি হত্যা মামলায় কিশোরগঞ্জ কারাগারে ছিলেন। কিশোরগঞ্জ সদর থানাধীন শহরতলির কাটাবাড়িয়া গ্রামের আব্দুলবারী খানসহ বেশ কজন সাহসী যুবক বসুকে কারাগার থেকে বের করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে উৎসাহিত করেন।
বসু মুক্তি পেয়ে নিজ এলাকা গুরুই গ্রামে চলে আসেন। সেখানে তার অনুগত ও অন্যান্য যুবকদের সংগঠিত করে গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। যারা স্থানীয়ভিত্তিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে হানাদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। বসুবাহিনীর বিভিন্ন দুর্ভেদ্য প্রতিরোধের কারণে মুক্তিযুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময়ই গুরুইসহ সন্নিহিত এলাকা কটিয়াদী, বাজিতপুর, নিকলী, অষ্ট্রগ্রাম, ইটনা, মিঠামইন, তারাইল, লাখাই, মদন এলাকা হানাদারমুক্ত এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু তার গড়া মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীটি প্রবাসী সরকার দ্বারা অনুমোদিত ছিল না।
বসুর দলের উচ্চ শিক্ষিত কমান্ডার সাবেক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব মিয়ার ভাষ্য মতে বসুকে উচ্চতর ট্রেনিং নিতে তিনবার ভারতে পাঠালেও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে, কেননা একজন দুর্ধষ ডাকাত হিসাবে তার পরিচিতি ভারতে অবস্থানরত রাজনৈতিক হাইকমান্ডের কাছে আগেই চলে যায়। তখন স্থানীয় কয়েকজন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যুদ্ধাবস্থায় জনসাধারণকে সংগঠিত না করে হাওরাঞ্চলকে সম্পুর্ণ অরক্ষিত রেখেই ভারতে পাড়ি জমান। বসুর উচ্চতর ট্রেনিংয়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার অতীত ডাকাতি।
বসু ভারত থেকে ট্রেনিং নিতে ব্যর্থ হয়ে এলাকায় ফিরে আসেন। সম্পুর্ণ নিজস্ব লোকবল নিয়ে প্রাথমিকভাবে কিছু দেশীয় বন্দুক ও কয়েকটি রাইফেল নিয়ে একটি মুক্তিযোদ্ধা দল গড়ে তুলেন। পরে এর নাম হয় বসুবাহিনী।
এই খবর ভারতে পৌঁছানোর পর দুই দফায় ফোর্স পাঠানো হয় বসুকে হত্যার জন্য। দুইবারই ইয়াকুব মিয়া তাদের বুঝিয়ে ফেরত পাঠান। তিনি ছিলেন বসুবাহিনীর কমান্ডার। তিনি সেক্টর কমান্ডার মেজর কে. এম. শফিউল্লাহকে তথ্য দেন বসু স্বাধীনতার স্বপক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করছে।
পরবর্তীতে সেক্টর কমান্ডার মেজর কে. এম. শফিউল্লাহ বসুবাহিনীর কমান্ডার প্রফেসর ইয়াকুব মিয়াকে ডেকে পাঠান এবং বলেন “প্রফেসর, আপনি ডাকাত নিয়ে যুদ্ধে নেমেছেন, একসময় মানুষ আপনার দিকে আংগুল তুলে বলবে আপনি ডাকাত নিয়ে চলেন।”
একদিন বসুবাহিনী জানতে পারেন, পার্শ্ববর্তী নরসিংদী জেলার বর্তমান বেলাব উপজেলায় বিশিষ্ট ন্যাপ নেতা জনাব আব্দুল হাইয়ের নেতৃত্বে উজলাবর গ্রামে প্রবাসী সরকারের অনুমোদিত একটি মুক্তিযোদ্ধা দল প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করেছে। সংবাদ পেয়ে দলনেতা বসু তার দলের উচ্চশিক্ষিত যোদ্ধা প্রফেসর ইয়াকুব মিয়াকে উজলাবর গ্রামে ন্যাপ নেতা আব্দুল হাইয়ের কাছে পাঠান। প্রফেসর ইয়াকুব সেখান থেকে ফিরে আসার আগেই বসু তার দলবল ও হাতিয়ার নিয়ে রাতের অন্ধকারে উজলাবর গ্রামে আব্দুল হাইয়ের ক্যাম্পে উপস্থিত হন। সেখানে ন্যাপ নেতা আব্দুল হাইয়ের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে তারা উজলাবর ক্যাম্পে সপ্তাহখানেক প্রশিক্ষণ নেন।
অতঃপর ন্যাপ নেতা বসুবাহিনীকে সশস্ত্র অবস্থায় নিজ এলাকায় পাঠান। বসু তার দল নিয়ে গুরুই গ্রামের কাছে হিলচিয়া গ্রামে এসে জনৈক বাদল পালের বাড়িতে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেন। এ সময় বসুবাহিনী স্থানীয় দুইজন কুখ্যাত দালালকে হত্যা করেন।
সম্মুখযুদ্ধ
গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সেনানী ছিলেন বসু, তার প্রতিষ্ঠিত মুক্তাঞ্চলে (৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১) নিকলী, পাঁচরুখী ও কুর্শা গ্রামসহ আশপাশের অন্যান্য এলাকা থেকে বসু ও তার সহযোগী কমান্ডার মহিউদ্দীনের কাছে খবর আসে যে, আজ লঞ্চ ও নৌকাযোগে পাকবাহিনী এবং রাজাকারবাহিনী গুরুই গ্রামে অপারেশন চালাবে। খবর পেয়েই হিলচিয়া ক্যাম্প থেকে বসুবাহিনী নৌকাযাগে গুরুই গ্রামে চলে আসে। তারা এসে দেখতে পায় যে, পাকবাহিনী ও রাজাকারবাহিনী ইতোমধ্যে গুরুই গ্রামে অপারেশন শুরু করে দিয়েছে মেজর দুররানীর নির্দেশে- কমান্ডার আসলাম ও ফিরোজের নেতৃত্বে। পাকবাহিনী ও রাজাকারের হাত থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য নিরীহ গ্রামবাসী মসজিদপাড়ার একটি মসজিদে আশ্রয় নেন।
বসুবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শুরু হয় মরনপন সম্মুখযুদ্ধ । এই যুদ্ধে গুরুই গ্রামের ২৫ সাধারণ নারী পুরুষ নিহত হন। পক্ষান্তরে ৫ জন পাক আর্মি ও ১০ জন রাজাকার এই যুদ্ধে প্রাণ হারায়। পরবর্তীতে পাকবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে বসুবাহিনীর অন্যতম মুক্তিযোদ্ধা সামছুল হকের অবদান ছিল প্রশংসনীয়।
বসুবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা
বসুবাহিনীর বীর যোদ্ধাদের মধ্যে যে কয়েকজনের নাম জানা গেছে, তারা হলেন প্রফেসর ইয়াকুব, আব্দুল বারী খান, গুরুই গ্রামের মহীউদ্দীন, হাবিলদার হাফিজউদ্দীন, দিয়ারিশ মিয়া, একে এম আনোয়ারুল হক, নূরুল ইসলাম, আবুল কাশেম, আবুল বাসার, সামসুল হক (সমু), বেচু, মহাতাব, নেফর আলী, সাহেদ আলী, আব্দুল ওয়াহাব, আবু, তাহের, রফিকুল ইসলাম শিরু, কামাল উদ্দিন খান, সিদ্দিক, কফিল উদ্দীন, কেন্দু মুন্সী, শহর আলী, আব্দুল হাশিম, কানা হাশিম মতি মিয়া প্রমুখ।
বসুবাহিনীর প্রধান আব্দুল মোতালেব বসুর নামে জারিকৃত ২৫টি মামলা যা মুক্তিযুদ্ধের আগে বিভিন্ন অপরাধে রজ্জুকৃত ছিল তা স্বাধীনতার পর সৈয়দ নজরুল ইসলামের অনুরোধে সরকারের আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন কর্তৃক তুলে নেয়া হলেও তৎকালীন স্থানীয় ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনীতির নির্মম শিকার হয়ে নিজ গ্রামে আততায়ীর গুলিতে বসু নিহত হন।
লোকমুখে জানা গেছে, পরবর্তীতে তার লাশ নৌকা যোগে পার্শ্ববর্তী ছাতিরচর সংলগ্ন খড়স্রোতা ঘোড়াউত্রা নদীতে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেয়া হয়। আজো তার খুনীদের বের করার প্রশাসনিক উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
৭১-এ যুদ্ধের সময় ও পরে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান কয়েকবার ‘বসুবাহিনী’র প্রধান আব্দুল মোতালিব বসুর বাড়িতে যান এবং কিছু বিষয়ে বৈঠক করেন। স্বাধীনতার পর জিল্লুর রহমান আওয়ামী লীগে যোগ দিতে বসুকে উৎসাহ দেন। যোগদান অনুষ্ঠানে বসুকে স্বর্ণের মালা উপহার দেন। এভাবেই স্বাধীনতা পরবর্তী বাজিতপুর, নিকলীর রাজনীতিতে বসুর প্রবেশ।
বসুর মৃত্যুর পর তার পরিবার একরকম কোণঠাসা হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য পরবর্তীতে মেলেনি কোনো স্বীকৃতিও। রাষ্ট্রীয় কোনো সুযোগ-সুবিধা না পেয়ে ভিটাবাড়ি হারিয়ে বসুর স্ত্রী চট্টগ্রামে পাড়ি দেন। সেখানে তার ছেলে নজরুল রিকশা চালান এবং স্ত্রী ভিক্ষাবৃত্তি করেন।
লেখাটি এখনো অসমাপ্ত।