মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যকে একটি স্বাধীন রাস্ট্রে রুপদানের লক্ষ্যে প্রায় এক যুগ আগে গঠিত হয় আরাকান আর্মি নামক বিদ্রোহী সংগঠন। সে লক্ষ্যে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে আরাকান আর্মি। তবে রাখাইন বা আরাকান রাজ্য বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়া সত্তেও মিয়ানমারের অভ্যন্তরীন বিষয়ে কখনো নাক গলায়নি বাংলাদেশ।
কিন্তু ২০১৫ সালে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নিকটবর্তী বান্দরবান জেলা দুর্গম হওয়ায় সেখানে ঘাটি নির্মাণ করার লক্ষ্যে ঘোড়ায় করে পন্য পরিবহন শুরু করে মিয়ানমারের বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। বিষয়টি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ অর্থাৎ বিজিবির নজরে এলে আরাকান আর্মির ১০ টি ঘোড়া তারা আটক করে। ঘোড়া আটকের প্রতিশোধ নিতে ২০১৫ সালের ২৫ আগস্ট বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে টহলরত একটি বিজিবি টহল দলের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায় বিচ্ছিন্নতাবাদী আরাকান আর্মি। দ্রুত এবং অপ্রত্যাশিত এই আক্রমনের জন্য তখন বিজিবি মোটেই প্রস্তুত ছিল না।
সেদিন সকাল সাড়ে ৯ টায় ২০ জন বিজিবি সদস্যের একটি দল বান্দরবানের থানচি সীমান্তের সাঙ্গু নদীর কাছে বড় মোদক এলাকায় নৌকা যোগে টহল দিচ্ছিল। এ সময় পাহাড়ের উপর থেকে আরাকান আর্মিরা তাদের ঘিরে ফেলে এবং অতর্কিত গুলি চালায়। তৎক্ষণাৎ বিজিবি সদস্যরাও পাল্ট গুলি করে এবং তাদের মধ্যে পাঁচ ঘণ্টা বন্দুকযুদ্ধ অব্যাহত থাকে। এ সময় বিজিবির দু’জন সদস্য আহত হন।
সংঘাতের সংবাদ জানার পর, বিজিবি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। শক্তিবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কর্তৃপক্ষ বিজিবি’র একটি এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিটকে সমন্বিত অভিযান পরিচালনার জন্য হেলিকপ্টারে করে ওই অঞ্চলে প্রেরণ করে। তবে তারা পৌঁছানোর আগেই বিজিবি সদস্যরা আরাকান আর্মির সঙ্গে গোলগুলি করে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। এসময় আরাকান আর্মি বর মোদকের বিজিবি ফাঁড়ি ঘেরাও এবং অবরোধ করে রাখে।
এ ঘটনার পর পরই বিকাল ৩ টার দিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে একটি যৌথ অভিযান শুরু করে। সেনাবাহিনীর দুটি, বিজিবির একটি ও বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি F-7 যুদ্ধ বিমান এই অভিযানে অংশ নেয়। সেসময় বাংলাদেশ সরকারের আহবানে মিয়ানমার সরকার তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়।
বন্দুকযুদ্ধের সময় আহত দুই বিজিবি সদস্যদের উদ্ধার করে হেলিকপ্টার দিয়ে চট্টগ্রামের সিএমএইচ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়।
বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর আক্রমনে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই আরাকান আর্মি পিছু হটে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আসে। গুলি বিনিময়কালে ৮ থেকে ২০ জন আরাকান আর্মি হতাহত হয়। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, সীমান্ত ছেড়ে পালিয়ে যাবার সময় আরাকান আর্মি তাদের ৮ থেকে ২০ জন সেনাকে টেনে নিয়ে যায়, এছাড়া সংঘর্ষের স্থানে রক্তের চিহ্নও দেখা যায়। অভিযানের পর দুটি ঘোড়ার মৃত্যদেহ সহ তাদের সামরিক সরঞ্জার ও গোলাবারুদ উদ্ধার হয়।
পরবর্তীতে রাঙামাটি জেলায় সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবির চিরুনি অভিযানে আরাকান আর্মির ইউনিফর্ম, ল্যাপটপ, ডিজিটাল ক্যামেরা, মোটরসাইকেল এবং দুটি ঘোড়া সহ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরকম একটি অভিযানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অপহৃত দুই সদস্যকে উদ্ধার করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠায় বিজিবি।
সংঘর্ষের পরদিন তৎকালীন বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল যুদ্ধের স্থানটি পরিদর্শন করেন। এক বিবৃতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যে এলাকায় অভিযান চালানো হচ্ছে সেটি খুবই দুর্গম। ক্যাম্প থেকে সীমান্ত পর্যন্ত হেঁটে যেতে ২-৩ দিন লেগে যায়। জঙ্গলের ভেতরে এমন অবস্থা যে, দিনের বেলায়ও আলো ফেলে হাঁটতে হয়। এমন দুর্গম এলাকায় অভিযান চালানো কষ্টসাধ্য বিষয়। এরপরও আরাকান আর্মিকে নির্মূল করতে যৌথ বাহিনীর চিরুনী অভিযান অব্যাহত থাকবে বলা জানান তিনি।
সেবারই প্রথমবারের মতো আরাকান আর্মির মুখোমুখি হয়েছিল বিজিবি। সেই খণ্ডযুদ্ধের পর আরাকান আর্মি আর বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশের সাহস করেনি।
সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলঃ MKN Bangla
ভিডিও লিংকঃ বাংলাদেশ বনাম আরাকান আর্মির যুদ্ধ ২০১৫ (ভিডিও)