muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

বিনোদন

পুঁজিবাদী ও শ্রেণিবিভক্ত সমাজের চিত্র তুলে ধরে বৈষম্য-জার্নি অব দা হার্ট

Boishommo-movie

যে বয়সে একটি কিশোরের থাকার কথা স্কুলে, সে বয়সে কেন তাকে পথে পথে ঘুরে বিক্রি করতে হয় শ্রম? ধনীর আদরের সন্তান যখন পছন্দের সুখাদ্য আস্বাদন করে তখন একটু খাবারের আশায় দরিদ্র কিশোরকে কাঁধে তুলে নিতে হয় অপরাধের বোঝা। এই বৈষম্য গ্রামের চেয়েও বেশি প্রকট হয়ে ওঠে নগর জীবনে|। পুঁজিবাদী ও শ্রেণিবিভক্ত সমাজের এই চিত্র তুলে ধরে ‘বৈষম্য-জার্নি অব দা হার্ট’ ছবিটি।

১০ ডিসেম্বর শুরু হওয়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসব ২০১৫র দ্বিতীয় দিনে শুক্রবার সকালে প্রদর্শিত হলো অ্যাডাম দৌলা পরিচালিত সিনেমাটি।

গতানুগতিক বাণিজ্যিক সিনেমা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ধাঁচের ছবিটির শুরুতে দেখা যায় ধনী পরিবারের কিশোর জেমি চৌধুরী ঢাকার একটি অভিজাত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্র। বাবা-মায়ের অতি আদরের সন্তান জেমি অহংকারী, উদ্ধত ও জেদি। গরীব মানুষকে সে মানুষ বলেই মনে করে না। ধনীর সন্তান বলে অন্যদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে সে দ্বিধা করে না। একদিন স্কুল থেকে জেমিকে নিজের কার্যালয়ে নিয়ে আসেন বাবা। সেখানে এক পর্যায়ে নিজের বাবার প্রতি অপমানজনক মন্তব্য করে সে। তার বাবার কিচেনওয়্যারের ব্যবসাকে ‘হাড়িপাতিলের’ ব্যবসা বলে তাচ্ছিল্য করে। জীবনের কঠোর বাস্তবতা সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার জন্য জেমিকে অফিস থেকে বের করে দেন বাবা। একটি ননস্টিক সসপ্যান তার হাতে তুলে দিয়ে বলেন সেটি তিন হাজার টাকায় বিক্রি করে যেন আসে। এটি বিক্রি না করতে পারলে বাড়ি ফিরতে পারবে না সে|। বিস্মিত ও ক্রদ্ধ জেমি বাবার অফিস থেকে বিতাড়িত হয়ে বাড়ি ফিরতে চেষ্টা করে।

গাড়ি ছাড়া সে কোনোদিন চলেনি। অটোরিকশা পায় না সে। পাবলিক বাসে চড়তে পারে না। বহুকষ্টে গুলশানের বাড়িতে পৌছানোর পর তাকে ঢুকতে দেয় না দারোয়ান|। কারণ বাবার নিষেধ। অপমানিত, ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত জেমি ঘুরে বেড়ায় নগরীর পথে পথে। দেখা হয় শ্রমজীবী শিশুদের সঙ্গে। প্রথম দিকে তাদের ঘৃণা করলেও ধীরে ধীরে সে বুঝতে শেখে ওদের কষ্ট। একরাত হাজতেও কাটাতে হয় তাকে। তার মানিব্যাগ পকেটমার হয়। অপরাধচক্রের সঙ্গে জড়িত কিশোরদের কারণে তার দামি মোবাইল ফোন, ঘড়ি এমনকি পরনের কাপড়ও হারাতে হয়। জেমির কাছে আর এমন কিছুই থাকে না যা তার উচ্চ শ্রেণির পরিচয় বহন করে।

এক মুঠো খাবারের আশায হন্যে হযে ঘোরে সে, রাত কাটায় ফুটপাথে, বস্তিতে। ধনীর ফেলে দেওযা উচ্ছিষ্ট খাবার খায়। অপরাধী এক কিশোরের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়লেও এক সময় সেই কিশোরটির প্রতি সহমর্মিতাও বোধ করে সে। সে বুঝতে পারে কত হতাশা ও অসহায়ত্ব থেকে একজন শিশু বিপথে যায়। বিপথগামী কিশোরটিও জেমির প্রতি করুণা বোধ করে।

এদিকে জেমিকে খুঁজে বের করার জন্য পুলিশে খবর দিয়ে তার বাবা নিজেও সপরিবারে খুঁজতে বের হন তাকে। অবশেষে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। তবে এখন আর জেমি উদ্ধত নয় বরং বিনয়ী এবং নতুন জীবনবোধে উদ্দীপ্ত।

ছবিটির কাহিনি অসাধারণ। অভিনয় মানসম্পন্ন। বিশেষ করে অন্যের উচ্ছিষ্ট খাবার গ্রহণের সময় জেমির কান্নায় ভেঙে পড়ার দৃশ্যটি দর্শকদেরও আপ্লুত করে। শ্রমজীবী শিশু কিশোরদের ছোট ছোট ভূমিকাগুলো প্রাণবন্ত হয়েছে পরিচালকের মুন্সীআনায়। অনেক বক্তব্য বলা হয়েছে ইঙ্গিতে ও চলচ্চিত্রের ভাষায় যা বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে বিরল। ছবির দৃশ্য ধারণে কখনো কখনো পেশাদারিত্বের কিছুটা অভাব দেখা গেছে। তবে এটুকু ত্রুটি মেনে নেওয়া যায়। সংগীত ছিল মানানসই।

জেমি চৌধুরির চরিত্রে অভিনয় করেছেন কিশোর আবীর হোসেন অঙ্কন। তিনি বর্তমানে ঢাকার পাবলিক রাইফেলস কলেজের ছাত্র|। বললেন, “চরিত্রটি পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে বেশ কষ্ট হয়েছে| খালি পায়ে হাঁটতে হয়েছে ইট কাঠ পাথরের মধ্যে।” ভবিষ্যতে আরো ভালো অভিনয় করতে চান তিনি। ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত অঙ্কন। কাজ করেছেন মঞ্চে। এর আগে সামিয়া জামান পরিচালিত ‘আকাশ কত দূরে’ চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। বেশ কয়েকটি টিভি বিজ্ঞাপনেও কাজ করেছেন।

ছবিতে জেমির বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরিচালক অ্যাডাম দৌলা নিজেই। মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন মিতা চৌধুরি।

ছবিটি মুক্তি পায় গত বছর ২১ মার্চ। অ্যাডাম দৌলা দীর্ঘদিন জার্মানিতে প্রবাসী ছিলেন|। তিনি এর আগে বেশ কয়েকটি বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেনে।‘বৈষম্য’ নির্মিত হয়েছে তার কীর্তনখোলা প্রোডাকশান হাউজের ব্যানারে|। ছবিটি স্বল্পবাজেটে নির্মিত|। সরকারি অনুদান পেলে ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে ছবি নির্মাণের আশা রাখেন তিনি।

অ্যাডাম দৌলা বললেন, “আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে মানুষে মানুষে যে বৈষম্য তা আমাকে পীড়িত করে। এই বৈষম্য তুলে ধরতে চেয়েছি। শিশু কিশোর ও তাদের বাবা-মায়ের মনোজগতে ছবিটি যদি কিছুটা প্রভাব ফেলে, তাহলে আমার প্রচেষ্টা সার্থক বলে মনে করবো।”

উৎসবে ছবি দেখতে এসেছিলেন ফারজানা শারমিন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিভি অ্যান্ড ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন। বললেন, “এই ছবি দেখে আমি দারুণ অনুপ্রাণিত হয়েছি। ছবিটি ঢাকার স্কুল-কলেজগুলোতে প্রদর্শিত হওয়া উচিত। শিশু কিশোরদের জন্য এ ধরনের ছবি আরও তৈরি হওয়া উচিত।”

‘বৈষম্য’ ছবিটি গত বছর ভারতের মুম্বাইয়ের রত্নগিরি এলাকার আনন্দ চিত্র মন্দির প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়। বাংলাদেশের কোনো সিনেমার বাণিজ্যিকভাবে ভারতে প্রদর্শিত হওয়ার প্রথম ঘটনা ছিল সেটি।

আমাদের দেশে শিশুতোষ চলচ্চিত্রের সংখ্যা নিতান্তই হাতেগোণা। নির্মিত ছবির মধ্যেও অধিকাংশই গতানুগতিক এবং জোরালো কোনো বক্তব্যহীন। সেদিক থেকে আশ্চর্য ব্যতিক্রম ‘বৈষম্য’। এই ছবি চিন্তাজগতকে আলোড়িত করবে আরও বহুদিন।

Tags: