muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

অষ্টগ্রাম

ভাল নেই হাওড়ের কৃষক : ভাত কাপড় আর ঋণের দায়ে দরজায় তালা দিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে অন্যত্র

মন্তোষ চক্রবর্তী, অষ্টগ্রাম (কিশোরগঞ্জ)।। 

কিশোরগঞ্জের হাওড় অঞ্চলে অষ্টগ্রাম উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মানুষ। ফসলী জমি করে, সারা জীবন কাজ করে মোটা ভাত, মোটা কাপড় পড়ে সুখে এই দিনাতিপাত করত। কিন্তু এবার ওরা বাঁচার অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। কি করে খাবে এবং কি দিয়ে ঋণ পরিশোধ করবে এসব ভাবনা অতিষ্ট হয়ে ওরা চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। যে সময়ে ওদের ঘরে সারা বছরের খাবার ধান সংগ্রহ করার কথা, ঠিক তার পূর্ব মুর্হুতে পাহাড়ি ঢল আর অকাল বন্যায় সব ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ওদের প্রত্যেকের ঘরে ৩ থেকে ৫ ছয়জন মানুষ রয়েছে। প্রতি পরিবারেরই ৫০ শতাংশ থেকে ১০ একর পর্যন্ত ফসলী জমি রয়েছে। যাদের নিজের জমিতে পরিবারের খাবার সংগ্রহ করা সম্ভব না হয়, তারা বৈশাখে মজুরি বিক্রি করে সারা বছরের খাবার যোগাড় করে নিত।

এবার ঘটেছে ভাগ্য বিপর্যয় সব জমি তলিয়ে যাওয়ার পর এলাকার হাহাকার সৃষ্টি হয়ে গেছে। অনেকের চোখের পানি ঝড়িয়ে আর কান্নাকাটি করেও বাঁচার কোন পথ পাচ্ছেন না। কৃষকের রয়েছে মহাজনী ঋণ এবং সরকারী-বেসরকারী ব্যাংক ও এনজিও থেকে আনা লক্ষ লক্ষ টাকার ঋণ। ছোট কৃষক আর প্রান্তিক চাষীর এবং ক্ষেত মজুর শ্রেণীর লোকজন প্রায় ৯৮ ভাগ বিভিন্ন এনজিও থেকে লক্ষকোটি টাকা ঋণ করেছে। মহাজনের লাঠিয়াল বাহিনী আর ব্যাংকের ঋণের চাপের সাথে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক কিস্তির এনজিও তাগিদ ওদেরকে অতিষ্ট করে তুলছে।

উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ঘুরেঘুরে দেখা গেছে, নারগিছ (৩২), স্বাধীন (৪৫), সামছুন্নাহার (৪০), সাইরুন (৩০), সুবল (৫০), রোকসানা (২৮), কাজল (৩৫), নুরজাহান (২৫), জিন্নত আলী (২০), জেসমিন (২২), আরজু মিয়া (৬০), মাখন (৩০), সংকর (৪৫), স্বপন (৪০). সম্পদ (৩৮), রমাকান্ত্রর স্ত্রী (৩৫), পংকজ (২৫), অধীর (৫০), উত্তম (২২) নামের লোকজন বসত ঘরে তালা ডুকিয়ে অনেকেই চলে গেছেন শহরে, আবার অনেকে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছেন। একদিক নেই খাবার ও পড়ার সংস্থান তার উপরে ঋণের তাগিদে এসব পরিবার চরম অবস্থার পতিত হয়েছে বলে জানা গেছে।

পানির নিচে পড়ে থাকা পাকা ধানের ফসল কদিন কুড়িয়ে এনে গরীবেরা খাওয়া পড়া চালাচ্ছে। এখন আর তাও নেই। গবাদি পশু পানির দামে বিক্রি করে কেউ কেউ ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বৈশাখে ধান কাটার পর এই অ লের প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঝমজমাট হয়ে উঠতো। বিশেষ করে কাপড়ের দোকানে এসব পরিবারের সারা বৎসরের কাপড় বিক্রি করত। এবার আর তা নেই।

অষ্টগ্রাম উপজেলা বাজারের ব্যবসায়ী সন্তোষ দেবনাথ ও ভ্যান্ডারী বাজারের ব্যবসায়ী হাসান আলী মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠকে জানান প্রতিদিন এই মৌসুমে এক-দুই লক্ষ টাকা বিক্রি হতো এবার দুই-তিন হাজার টাকাও বিক্রি করতে পারছি না। হাট-বাজার গুলি ঘুরে দেখা যাচ্ছে। সর্বত্র স্থবির অবস্থা। পানির নিচে থেকে আহোরিত পচা ধানের চাল খেয়ে ইতিমধ্যে অনেকে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন এবং পচা ক্ষের বিচালী খেয়ে গবাদী পশু মরতে শুরু করেছে।

স্থানীয় কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে এই উপজেলার ২৪ হাজার হেক্টর ক্ষেতে বুরোর আবাদ হয়েছিল। ফলন ও বাম্পারের সম্ভাবনা ছিল। অকাল বন্যায় ৭৩ ভাগ ফসল বিনষ্ট হয়ে গেছে। বেসরকারী হিসাবে ক্ষতি পরিমান ৯১ ভাগ। খয়েরপুর আব্দুল্লাপুর আদমপুর কলমা ইউনিয়নের শতভাগ ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। পূর্ব অষ্টগ্রাম, কাস্তুল, সাভিয়ানগর, বাংগালপাড়া ও অষ্টগ্রাম সদর ইউনিয়নে ও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যার পর দু’বার ঘূর্ণিঝড় ব্রজপাত প্রবল বর্ষনে বসত ঘর উড়িয়ে নিয়ে গেছে। মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। হাওড় অঞ্চলের মানুষ চরম বিপন্ন। যে উপজেলার উৎপাদিত ধানের ২০ শতাংশে স্থানীয় খাদ্য চাহিদা পূরর্ণ করে ৮০ ভাগ জাতীয় খাদ্য ভান্ডারে যোগান হত, সেই উপজেলার মানুষ খাদ্য আরও কাজের সন্ধানে ঘরে তালা ঝুলিয়ে চলে যাচ্ছে।

কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসন থেকে এই উপজেলায় মাত্র ১৭ হাজার পরিবারে ৩০ কেজি চাল ও ৫০০ টাকা করে বিশেষ ভিজিএফ প্রদান করেছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জাকির হুসাইন জানান নতুন করে এই উপজেলায় আরও দুই হাজার পরিবারে বিশেষ ভিজিএফ দেওয়া হবে। তবে তাদের নগদ টাকা দেওয়া হবে না। সরকারী ত্রান সর্ম্পকে অভিজ্ঞ ও অসংখ্য লোকের ভাষ্য এইগুলি লোকদেখানো ও সমুদ্র ছিন্নছনের মত।

একজন মুক্তিযোদ্ধা সহ কয়েকজন বিশিষ্ট লোকের ভাষ্য সরকারে যারা রয়েছেন তাদের সংখ্যা গরীষ্টই ধন কূবরের পুত্র এবং হাওড় অঞ্চল সর্ম্পকে তাদের ধারনা নেই। তাই হাওড়ের মানুষের বাঁচা, মরা এখন বিধার ও প্রকৃতির উপর। এলাকা ছেড়ে যারা চলে যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশ ঢাকা চিটাগাং, খুলনা, সিলেট সহ বিভিন্ন স্থানে চলে যাবেন। ওরা জানেনা সেখানে গিয়ে কি করবেন এবং কীকরে বাঁচবেন। কিছু কিছু লোক বলছেন ওরা রাজমিস্ত্রী যোগালী ও দিনমজুরী করে খাওয়া পড়া এবং বাসা ভাড়ার সংস্থান করবেন। ওদের সামনে আসছে অনিশ্চিত ভবিষ্যত। সরকার ও দাতা সংস্থা হাওড়ের ফসল রক্ষার জন্য এই উপজেলায় প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকা বরাদ্ধ দেন কিন্তু তদারকির অভাবে কোথায় কি হচ্ছে তা কেউ জানেনা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তদন্তকারী কর্মকর্তারা প্রতি বছর জৈষ্ঠ্যে বর্ষার পানি আসলে প্রকল্প গুলি দেখতে আছেন, যখন সব প্রকল্প পানির নিচে তলিয়ে যায়। গত ক’বছর খয়েরপুর আব্দুল্লাপুর ইউনিয়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রচার কাজ করেছে বলে শুনা যায়। কিন্তু সেখানে কোন সাইনবোর্ড বা প্রকল্প চোখে দেখা যায় না। সব মিলিয়ে হাওড়ের মানুষ এখন বাঁচার অধিকার হারা। সর্বত্র হা হা কার বিরাজ করছে। খাদ্য ও কর্মস্থানের ব্যবস্থা না হলে এক দুই মাসের মধ্যেই এই এলাকায় অনাহারে মানুষের মরন সৃষ্টি হবে বলে অভিজ্ঞদের ধারনা।

এ ব্যাপারে পূর্ব অষ্টগ্রাম ইউ.পির চেয়ারম্যান কাছিদ মিয়ামুক্তিযোদ্ধার কন্ঠকে  জানান এনজিও, ঋণ দাতা সংস্থা ও স্থানীয় মহাজনদের চাপে ইতিপূর্বেই বহু পরিবার নিজের বসত বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে।
 

মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ ডোটকম/৩১-০৫-২০১৭ইং/ অর্থ 

Tags: