muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

জাতীয়

একজন মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধ জয়ের গল্প : ৩য় পর্ব

১ম পর্ব : একজন মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধে যাওয়ার, যুদ্ধের প্রশিক্ষন নেওয়ার ও যুদ্ধ জয় করার গল্প

২য় পর্ব : একজন মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধে যাওয়ার, যুদ্ধের প্রশিক্ষন নেওয়ার ও যুদ্ধ জয় করার গল্প

ইতিপূর্বে আমার পর পর ২ টি যুদ্ধের গল্প ও ২ টি ভয়াবহ যুদ্ধ (৪ঠা অক্টোবর ও ২৭শে নভেম্বর ১৯৭১) প্রকাশ করা হয়েছে। তা যুদ্ধের ৪৭ বছর পর লিখা হলেও ইহা কোন আষাঢ়ী গল্প নয়; সম্পূর্ণ সত্য।

আরও পড়ুন : ৪ অক্টোবর ১৯৭১ : পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সদরদপ্তর বেদখল ও পুনর্দখলের যুদ্ধ

আরও পড়ুন : ২৭ নভেম্বর ১৯৭১, সুনামগঞ্জে ভয়াবহ ‘লাশ টানাটানির যুদ্ধ’ : বীর মুক্তিযোদ্ধা নিছার আহমদ

আমাদের যুদ্ধের মূল প্রশিক্ষণ ছিল গেরিলা যুদ্ধ, অর্থাৎ হিট এন্ড রান। কিন্তু মুজিবনগর সরকার যুদ্ধের সেক্টর গঠন করলে আমরা সুনামগঞ্জ সীমান্তের মেঘালয় রাজ্যের বালাট বর্ডারে যুদ্ধের পোস্টিং পাই। আমাদের সম্মুখ যুদ্ধের ট্রেনিং না থাকলেও আমরা সম্মুখ সমরে ও বাংকারে যুদ্ধ করার নির্দেশ পাই। ইতিপূর্বে আমার যুদ্ধের গল্পে খুব সাফল্য বর্ননা করা না হলেও তৎকালীন বিশ্বের সেরা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত পাকিস্তানি ল্যান্ড ফোর্সের সাথে আমাদের সম্মুখ যুদ্ধ করতে হয়। আমার যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় আমি মনেকরি, পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়াটাই আমাদের বড় সাফল্য। যার ফলশ্রুতিতে পাকবাহিনী পিছু হটতে থাকে এবং দেশ স্বাধীন হয়।

ভরতের মেঘালয় রাজ্যের বর্ডার

যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমরা ৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ খুব ভোরে খবর পেলাম পাকবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে সুনামগঞ্জ শহরে একত্রিত হয়ে সিলেটের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটা কোম্পানি তড়িৎ গতিতে পায়ে হেটে সুনামগঞ্জ শহরের উত্তর দিকে সুরমা নদীর পাড়ে সকাল ১০ টায় অবস্থান নেই। বেলা ১১ টার দিকে আমাদের সুনামগঞ্জ সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ মুত্তালিব ভারতীয় বালাটের মিত্র বাহিনীর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন ইয়াদবকে নিয়ে সুনামগঞ্জ শহরের সুরমা পাড়ে পৌছায় এবং বিশেষ নৌকায় আমাদেরকে নিয়ে নদী পাড় হয়ে সুনামগঞ্জ শহরে প্রবেশ করেন। দুপুর ১২ টার দিকে তৎকালীন সুনামগঞ্জ শহরের এস ডি ও অফিসে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল সবুজের জাতীয় পতাকা আমাদের উপস্থিতিতে যৌথ ভাবে উত্তোলন করা হয়।

এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাদের অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়

পরবর্তীতে ২ দিন পর আমাদের ডি কম্পানিকে অগ্রগামী দল হিসেবে সিলেটে রোডে জয়কলস নামক স্থানে পাঠানো হয়। আমরা ১০ দিন জয়কলস উজানিগাও হাইস্কুলে অবস্থান করি। ইতিমধ্যে পাক বাহিনীর হাতে ধৃত ৪ জন মুক্তিযোদ্ধার গলিত লাশ সনাক্ত করে নদীর পাড়ে দাফন করি। জয়কলসে কুখ্যাত সাত্তার দালালের বাড়ি থাকায় এখানে একটি রাজাকার ক্যাম্প ছিল। রাজাকাররা জয়কলস এলাকার আশেপাশের গ্রামে অসংখ্য যুবতী মেয়েকে বিয়ে করে গর্ভবতী করে পালিয়ে যায়। পাকবাহিনী জয়কলস সহ অনেক গ্রামে লেবিতে ধান আদায় করে অনেকের বাড়িতে তাদের জিম্মায় রাখে। আমরা সেই ধান উদ্ধার করে সুনামগঞ্জে প্রেরণ করি। আমাদের অগ্রগামী গোবিন্দগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট ৭ জন পাক সেনা আত্নসমর্পন করলে তারা পাক সেনাদের সুনামগঞ্জে প্রেরনের জন্য আমাদের নিকট পাঠালে আমরা পাক সেনাদের সাব সেক্টর কমান্ডারের মাধ্যমে সুনামগঞ্জ জেলে প্রেরণ করি। অতঃপর ১৬ ডিসেম্বর পাক সেনাদের আত্নসমর্পনের পর আমরা ২০ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ শহরে চলে আসি এবং আমাদের ডি কোম্পানিকে হাসন রাজার বাড়িতে রাজকীয় বাংলোয় থাকতে দেয়া হয়। কিছুদিন হাসন রাজার বাড়িতে অবস্থানের পর আমাদের সুরমা নদীর ওপাড়ে সরকারি খাদ্য গুদামের পাশের মাঠে টিনের চালা ঘরে থাকতে দেয়া হয়। আমরা সেখানে ২১ শে ফেব্রুয়ারী ১৯৭১ পর্যন্ত অবস্থান করি এবং সুনামগঞ্জ সাব সেক্টর হেড কোয়াটার খাদ্য গুদামের অফিসে স্থাপন করা হয়।

কিন্তু এর মাঝে ১০ই জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে আমাদের সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ মুত্তালিব বঙ্গবন্ধুর হাতে আমাদের অশ্র জমা দেয়ার খায়েশ করেন। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ১২ নম্বর আসামি হয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী ছিলেন। কিন্তু আমাদের সর্বশেষ ৫ নং সেক্টর কমান্ডার কর্নেল সি আর দত্ত সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ এসে আমাদেরকে অশ্র জমার ব্যাপার নিয়ে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করেন। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা উত্তেজিত হয়ে অশ্র জমা না দিয়ে কর্নেল সি আর দত্তের উপস্তিতিতে আকাশে অনবরত ফাঁকা গুলি ছুড়তে থাকে। তাৎক্ষণিক মেজর এম এ মুত্তালিব ও লেফটেনেন্ট এস কে লালার সহায়তায় কর্নেল সি আর দত্তকে স্পীড বোর্ড দিয়ে সুরমা নদী পার করে সিলেটের দিকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তৎকালীন পররাস্ট্রমন্ত্রী জনাব আব্দুস সামাদ আজাদ এসে আমাদের নিকট হইতে অশ্র জমা নেন।

যুদ্ধ শেষে অশ্র জমা দেয়ার পূর্বে সুনামগঞ্জ শহরে টেকের ঘাটের কমান্ডার মেজর মুসলে উদ্দিনের সাথে আমাদের সাব সেক্টর কমান্ডারের ভুল বোঝাবুঝিতে এক রাত্রে নদীর এপাড় ওপাড় আমাদের দুপক্ষের গোলাগুলিতে সুরমা নদীতে লঞ্চের উপর থাকা এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে।

উল্লেখ্য, যুদ্ধ শুরুতে চিনাকন্দি বর্ডারের তৎকালীন ই পি আর ক্যাম্পের হাবিলদার গনি প্রথমে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলে। তবে তিনি নিজে কিছু অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েন। স্থানীয় তার কিছু ভিন্ন মতের লোককে নানাভাবে অত্যাচার করে, যেমনঃ চিনাকান্দি বাজারের নিরপরাধ চিনির বাপ মাতাব্বরকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। স্থানীয় ধনী প্রভাবশালী কেনা মড়ল তার ভয়ে পালিয়ে গেলে সব বাড়িঘর ভেঙ্গে নিয়ে এসে ভারতের চিনাকান্দি বর্ডারে টিনের দোতলা বাড়ি নির্মান করে হেরেমে পরিনত করে। তাছাড়া অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে অহেতুক গালিগালাজ ও বেত্রাঘাত করতো। পরে স্থানীয় সাব সেক্টর কমান্ডারের মাধ্যমে প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী ও মুজিবনগর সরকারকে অবহিত করিলে গনি হাবিলদারকে গ্রেফতার করে ভারতে প্রেরণের নির্দেশ আসলে আমাদের ডি কোম্পানি কমান্ডার জালাল উদ্দিনের নেতৃত্বে গনি হাবিলদারকে নিরস্ত্র করে গ্রেফতার করে ভারতীয় বাহিনীর নিকট হস্তান্তর করি।

২১ শে ফেব্রুয়ারী ১৯৭১ মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র ও মুভমেন্ট অর্ডার বিতরণ করে আমরাও নিজ বাড়ি কিশোরগঞ্জে চলে আসি এবং মহকুমা প্রশাসকের নিকট রিপোর্ট করে দেশরক্ষা বিভাগের সনদপত্র গ্রহন করে লেখাপড়ায় ফিরে যাই।

বীর মুক্তিযোদ্ধা নিছার আহমদ (রতন)
উপ-অধিনায়ক, ডি কোম্পানি, ৫ নং সাব সেক্টর সুনামগঞ্জ
সম্পাদক ও প্রকাশক, মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠ ডটকম

Tags: