muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

আবহাওয়া ও জলবায়ু

সচেতনতার অভাবে পরিবেশ-জীববৈচিত্রগত দূর্যোগ প্রশমণের সূফল পাচ্ছে না উপকূলের মানুষ

বরগুনার সমুদ্র তীরবর্তী স্থানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে লক্ষাধীক  জেলে। এ প্রান্তিক জনগোষ্ঠি দূর্যোগ প্রশমন দিবস, সুনামী, ভুমিকম্প, বজ্রপাত, সাইক্লোণ ও জলোচ্ছ¡াস সম্পর্কে সচেতন না। উপকুলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এ সচেতনতা থেকে বঞ্চিত। এছাড়াও উপকুলীয় এলাকায় প্রয়োজনের তুলনায় সাইক্লোণ সেল্টার অপ্রতুল। ঘুর্ণিঝড়ের সময় উপকুলীয় অঞ্চলের মানুষের আশ্রয় নেয়ার জন্য আরো সাইক্লোণ সেল্টার প্রয়োজন।

সমুদ্রতীর, বুড়িশ্বর ও আন্ধারমানিক দুটি বৃহৎ নদীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত আমতলী ও তালতলী উপজেলা। তালতলীর পচাঁকোড়ালিয়া, কড়াইবাড়িয়া, শারিকখালী, ছোটবগী, বড়বগী, নিশানবাড়িয়া ও সোনাকাটা ইউনিয়ন সমুদ্রের নিকটবর্তী হওয়ায় এটি চরম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। এ ছাড়া আড়পাঙ্গাশিয়া, আমতলী সদর,আমতলী পৌরসভা, গুলিশাখালী ইউনিয়ন পায়রা নদীর তীরবর্তী স্থানে হওয়ায় এ এলাকা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

উপকুলীয় অঞ্চল হওয়ায় অনাদিকাল সাইক্লোন, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস,ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে আমতলী ও তালতলীতে। এতে ব্যাপক জান মালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ১৯৭০ সালে ১২ নভেম্বর আমতলী ও তালতলীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ছিল প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়। এ জলোচ্ছ¡াসে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল শত কোটি টাকার সম্পদ। ২০০৭ সালে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় সিডরে আমতলী ও তালতলীর ২৯৭ জন মানুষ প্রাণ হারায়। এখনো নিখোঁজ রয়েছে ৪৯ জন এবং আহত হয় ২৫০০ জন। ওই সময় সবচেয়ে প্রাণহানী ঘটে তালতলীর বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী নিদ্রা, সখিনা, আশারচর, জয়ালভাঙ্গা ও ফকির হাট এলাকায়। এর একমাত্র কারন অসচেতনতা। যারা সাইক্লোণ সেল্টারে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের প্রাণহানী ঘটেনি। বেশী প্রাণহানী ঘটেছে সাগরে অবস্থানরত জেলেদের। জেলেদের অসচেতনতার জন্য এত প্রাণহানী।

আমতলী ও তালতলী উপজেলার লক্ষাধীক মানুষ সমুদ্র উপকুলীয় অঞ্চলে দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করেন। এদের প্রধান কাজ নদী ও সাগরে মাছ শিকার। এ উপকুলের মানুষ সচেতনতার দিক দিয়ে নিম্নমানের। এদের মধ্যে রয়েছে বেশীর ভাগ প্রান্তিক জেলে।  আমতলীতে নিবন্ধিত জেলে ৭ হাজার ২’শ ১০ ও তালতলীতে ৯ হাজার ৩শ’২১ জন। এছাড়া বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা নিবন্ধনের বাহিরে জেলে রয়েছে অর্ধলক্ষ। নিবন্ধনের বাহিরে অধিকাংশ জেলে সাগর ও সাগর মোহনায় পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করেন। এদের মধ্যে অনেকেই ঘূর্ণিঝড়, সুনামী, ভুমিকম্প, বজ্রপাত, সাইক্লোণ ও জলোচ্ছ্বাস সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে দূর্যোগ প্রশমণে সচেতনতা তৈরিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। যাদের সচেতন করতে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন তারা প্রশিক্ষণ পায়না এমনই অভিযোগ উপকুলবাসীর।

উপকূলীয় বেড়িবাঁধ উঁচুকরণ, আরও আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, দুর্যোগকালে সমুদ্রে জেলেদের সাথে যোগাযোগের উন্নত মাধ্যম ব্যবহার, কমিউনিটি রেডিও চালুকরণ, সচেতনতা অনুষ্ঠান  জোরদারকরণ,আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো, বন্যাপ্রবণ এলাকায় কিল্লা নির্মাণ, বন্যা প্রতিরোধে সবার করণীয় নির্ধারণ করে গাইডলাইন নির্মাণের ওপর গুরুত্বরোপের দাবী জানান সচেতন নাগরিক সমাজ। সমুদ্র তীরবর্তি যে আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য এমনটা জানালো স্থানীয়রা।

উপজেলা প্রকৌশলী অফিস সুত্রে জানাগেছে, দুই উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে ৬৬ টি। ওই আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে উপকুলীয় এলাকায় মাত্র ১০টি। আর উপকুলীয় এলাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করেন অন্ততঃ লক্ষধীক মানুষ। এতো জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার জন্য আরো সাইক্লোণ সেল্টার প্রয়োজন।

তালতলীর আশারচরের জেলে নাসির সিকদারের কাছে সুনামী, সাইক্লোন ও জলোচ্ছ¡াস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন সুনামী কি জানিনা। “সাইক্লোণ মোগো এলাকায় আছে। বইন্যা আইলে মোরা ওই সাইক্লোণে যাইয়্যা থাহি, বইন্যা, দেওই এর মধ্যে সাগরে জাল বাই আল্লায় মোগো বাঁচায়”।

সখিনা গ্রামের জেলে আঃসালাম বলেন, সাগর সংলগ্ন আশারচরে মৌসুম ভেদে জাল ফেলি। এ জীবনে বহুবার বন্যার কবলে পরেছি কিন্তু সুনামী কি তা জানিনা। তিনি অভিযোগ করে আরো বলেন, কেউ কোন দিন জেলেদের ঝড়, সাইক্লোণ ও জলোচ্ছ¡াস সম্পর্কে সচেতন করতে আসেনি।

আশারচরের মন্টু বিশ্বাস বলেন, গত ২০ বছর ধরে সাগরে হাজার হাজার জেলে বন্যার কবলে পরতে দেখেছি। অনেক জেলেকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করেছি। নিজে বন্যার কবলে পরেছি কিন্তু কেউ কোন দিন সাইক্লোণ, জলোচ্ছ্বাস, সুনামী, বজ্রপাত, ঘূর্ণিঝড় বিষয়ে সচেতন করতে আসেনি। তিনি আরো বলেন আশারচরে প্রায় ৫০ হাজার জেলে রয়েছে। এ সকল জেলেদের কেহ খোঁজ খবর নেয়নি, সচেতন করাতো দুরের কথা। তিনি সরকারের কাছে দাবী জানান আশার চরের জেলেদের বন্যা, সুনামী, বজ্রপাত, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়ে সচেতন করে তোলার।

সোনাকাটা ইউপি সদস্য আবদুস ছালাম হাওলাদার বলেন, সাগরের জেলেরা যুদ্ধ সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে। তারা বন্যা, সুনামী, সাইক্লোণ, জলোচ্ছ¡াস ও ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে সচেতন নয়। তাদের এগুলো সম্পর্কে সচেতন করলে তারা উপকৃত হতো। সরকার তা না করে উপজেলা শহরের সচেতন মানুষকে সচেতন করছে। প্রান্তিক জেলে ও সাগর পাড়ের প্রতিটি অসচেতন মানুষকে সচেতন করলে দূর্যোগ প্রশমণের সুফল পাবে উপকূলবাসী। তিনি আরো বলেন, বর্তমান মৌসুমে যে পরিমান জেলে আশারচর এলাকায় অবস্থান করছে ওই পরিমান আশ্রয়কেন্দ্র এখানে নেই। সকল জেলেদের আশ্রয় দিতে হলে আরো আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা প্রয়োজন।

তালতলী উপজেলা প্রকৌশলী আহম্মদ আলী বলেন, উপজেলায় ৪১ টি সাইক্লোণ সেল্টার রয়েছে। তার মধ্যে উপকুলীয় এলাকায় ১০টি। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ঘুর্ণিঝড়ের সময় উপকুলীয় অঞ্চলের মানুষের আশ্রয় নেয়ার জন্য আরো সাইক্লোণ সেল্টার প্রয়োজন।

তালতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার দীপায়ন দাস শুভ বলেন, উপকুলীয় এলাকায় পর্যাপ্ত সাইক্লোণ সেল্টার নেই। সাইক্লোণ সেল্টার নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। 

আমতল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মনিরা পারভীন বলেন, উপকুলের জনগোষ্ঠিকে সচেতন করার কাজ করছি। এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া।

Tags: