muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

মুক্তকলাম

কিশোরগঞ্জে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় : একটি প্রাসঙ্গিক ভাবনা

ফারুখ আহমদ : ছাত্রজীবনে নোবেল লরিয়েটের একটি লেখায় পড়েছিলাম, “সারা বিশ্বের উন্নয়নের পেয়ালাটা পরিপূর্ণ হয়ে উপচে পড়লে সেখান থেকে কিছু আমাদের এখানে পড়বে এবং আমরাও উন্নত হব। সেই প্রত্যাশায় বসে আছি”। কিশোরগঞ্জের আগে নেত্রকোনা আর জামালপুর জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় শুধু প্রতিষ্ঠা নয় বরং একাডেমিক কার্যক্রম চালু হওয়ার অনেক পর আমাদের ভাগ্যের শিকে ছিড়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ। এখন দেখার বিষয় আমরা সবসময় কিশোর থাকব, নাকি উনার দেওয়া উপহারকে আশির্বাদে পরিণত করব। আমার লেখাটা “কিশোরগঞ্জের উন্নয়ন ভাবনা” নিয়ে যারা কাজ করেন তাঁদের মধ্য থেকে কারও দৃষ্টিতে পড়লেই নিজেকে স্বার্থক মনে করব।

স্টাডি-১: খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
বুয়েটের অধ্যাপক ড. গোলাম রহমানকে প্রকল্প পরিচালক/১ম ভিসি নিয়োগ দিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করেছিল। শুরুতে অনুষদের স্থলে “স্কুল”, বিভাগের স্থলে “ডিসিপ্লিন” শব্দচয়নের মাধ্যমে তার স্বাতন্ত্র প্রকাশ করলেও ১ম ২/৩ ব্যাচের গ্র্যাজুয়েটরা যখন দেশ বিদেশের চাকুরীর বাজারে অন্যান্য মুরব্বী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের প্রতিযোগিতায় টেক্কা দেওয়া শুরু করল তখন বিভিন্ন সংস্থার নিয়োগকর্তাই নয় বরং সারা দেশের শিক্ষা সচেতন অভিভাবক ও ছাত্রদের অনেকটা আরাধ্য হয়ে ওঠল এ
বিশ্ববিদ্যালয়। পরের ইতিহাস সবার জানা।

স্টাডি-২: যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষামন্ত্রী এইচকে সাদেক সাহেব যশোর শহরে স্থান নির্ধারণ করে গেলেও তরিকুল সাহেব সেটাকে শহর থেকে ১৩ কি:মি: দূরে নিভৃত পল্লীতে ধান ক্ষেতে নিয়ে গেলেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম সরকার কে প্রকল্প পরিচালক/১ম ভিসি নিয়োগ দিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করেছিল। ২য় বার ক্ষমতায় এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১ম সমাবর্তনে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা দেখে বলেছিলেন, এই একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান খুব দ্রুত তার অভিষ্ট লক্ষে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। ২য় ভিসি’র বাড়ী ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই। বলেছিলাম নেতৃত্বের সফলতার কথা। বর্তমানে কোভিড টেস্টের কাজটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে এক মাসের বেশি কন্টিনিউ করতে অপারগতা প্রকাশ করলেন, সেখানে যশোর বিশ্ববিদ্যালয় এখনও কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা, বেনাপোলসহ বৃহত্তর যশোরের সর্বস্তরের মানুষের কোভিড-১৯ টেস্ট করে যাচ্ছে নিজস্ব ল্যাবে। একদম নতুন এবং স্বল্প বাজেটের ভিতর থেকেও তার গবেষণা ঈর্ষনীয়। এলাকার জনগণের প্রতি কতটুকু কমিটেড থাকলে একটা প্রতিষ্ঠান শিক্ষা সেবাই নয় স্বাস্থ্য সেবাও নিশ্চিত করেছেন। তাদের প্রতিটি ল্যাব গড়ে তুলেছে ঢাবি আর বুয়েটের ল্যাবের আদলে, ভাবা যায় ! ধান ক্ষেত এখন একটি আধুনিক মিনি শহর। আশেপাশের গ্রামের স্কুলগুলোর ছাত্ররা এখন অত্যন্ত ভাল রেজাল্ট করে। কারণ তাদেরকে পড়ায় ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মসী, জেনেটিক্স ও মাইক্রোবায়োলজির ছাত্ররা।

স্টাডি-৩: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্র আন্দোলনের অনাকাঙ্খিত ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নিকট অতীতে প্রায় দুই মাসের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হলে রাজশাহীর চেম্বার আর বনিক সমিতি কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করে ১ মাস পরেই
খুলে দিতে। নিরাপত্তার গ্যারান্টিও তারা প্রদান করে। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাশের রুয়েটকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের আড়াই লক্ষ লোক প্রত্যক্ষভাবে নির্ভশীল এ প্রতিষ্ঠানের উপর। ক্যাম্পাসে একজন বাদাম বিক্রেতা কিংবা ছাতার নীচে একটি টোল নিয়ে বসা মোবাইল রিচার্জ করা ব্যক্তি দিব্যি ৪/৫ সদস্যের সংসার চালায় এ কাজ করে। অন্যান্য ব্যবসা/পেশার কথা অনুমান করে নেন। কিশোরগঞ্জে মেসের ছাত্রকে মাংশ খেতে চাইলে পুরো ব্রয়লার মুরগীটা কিনতে হয়। কিন্তু রাবি’র ছাত্ররা এখনও দোকান থেকে আড়াইশো/তিনশ গ্রাম মাংশ কিনতে পারে। ভাবা যায়, সেখানে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কিভাবে সেবা প্রদান করে আর গ্রহণকারী ছাত্ররা সামর্থ অনুযায়ী কত সহজে সেবা কিনতে পারে ?

একটি জেলায় যদি ইন্ডাস্ট্রি করেন তাহলে সেখানে কয়েক হাজার শ্রমিক আসবে, কাজ করবে। যাদের বেতন পাঁচ হাজার থেকে বড়জোর দশ হাজার হতে পারে। যার মেক্সিমাম অংশ তার পারিবারিক ব্যয়। যদি বাইরে থেকে আসে তবে তার জীবন ধারণের জন্য ১/২ হাজার রেখে বাকি টাকা এ এলাকায় খরচ না করে বাড়ীতে পাঠাবে। কারণ মৌলিক ব্যয়। অফিসারের সংখা খুবই নগন্য এবং তারা সন্তানের লেখা পড়ার কথা চিন্তা করে এ এলাকায় থাকবে না। তাহলে দেখা যায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ায় আসলে টাকাটা থাকছে না। আর যদি একটি বিশ্ববিদ্যালয় করেন, তাহলে প্রথমেই আসে এলাকার উন্নয়নে সরকারের বড় বাজেট আর প্রশাসনের সার্বক্ষণিক নেক দৃষ্টি। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র এখানে আসবে পকেট ভরা টাকা নিয়ে। যখন যা লাগে অভিভাবক পাঠাবে, যার পুরোটাই এখানে ব্যয় হবে। এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পাবে ৫/৬
বছরের জন্য বান্ধা কাস্টমার। যে কখনও দামাদামি করে জিনিস কিনবে না। শ্রমিক যদি চা খায়, ছাত্র খাবে কফি। ছাত্র ছোটখাট চাপড়া দেওয়া হোটেলে বসবে না, দল বেঁধে বসবে রেস্টোরা আর ক্যাফে, বাজার করবে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। কাপড় কিনতে যাবে ব্র্যান্ডের বিপণী বিতানে। মোট কথা সুন্দর পরিবেশে। যেখানে এলাকার মানুষ সেবা প্রদাণকারী হিসেবে পাবে ন্যায্য পাওনা, যা তুলনামূলকভাবে বেশি। প্রতি ব্যাচেই কমপক্ষে ৩/৪ হাজার নতুন আগমণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের থাকবে উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারী। এককথায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় টাকার সার্বক্ষণিক ব্যাপক প্রবাহ এবং একটি সুন্দর সৃজনশীল পরিবেশ।

আমি প্রথমেই দুটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ এনেছিলাম, কত দ্রুত কিভাবে নিজের অবস্থান দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করেছে বুঝানোর জন্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশাল কর্মযজ্ঞ এবং উন্নয়নের উপলক্ষ কিশোরগঞ্জবাসীর হাতে তুলে দিয়েছেন। এখন আমাদের উচিত সেই কাজটি সুষ্ঠুভাবে এবং দ্রুত সম্পন্ন করার লক্ষ্যে কিশোরগঞ্জের উন্নয়নের জন্য কমিটেড নেতৃত্বের হাতে প্রতিষ্ঠানটি তুলে দেওয়া। এ জেলার বাসিন্দা হিসেবে প্রশাসনের উচ্চ পদে অনেক যোগ্য লোক রয়েছেন। রয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ
এলাকার সুযোগ্য ও বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক। আমি আশা করব আমরা এখনও আর কিশোর না থেকে নিজেরা সম্মিলিতভাবে একটু দায়িত্ব নিয়ে সচেতনতার সাথে সার্চ করে সেই লোকটিকে বের করব।
যিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে ২/৩ বছরের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করবেন এবং পরোক্ষভাবে কিশোরগঞ্জ শহরসহ আশেপাশের এলাকাকে আধুনিক করে গড়ে তুলতে সহযোগিতা করবেন। কিশোরগঞ্জের সর্বস্তরের সচেতন মহল এখনও যদি মনে করেন উপচে এমনি এমনি এসে পড়বে তাহলে ভুল করবেন। কারণ, একজন মন্ত্রী পাঁচ বছরে যা করতে পারেন, একজন ভিসি চার বছরে পারেন তার দশগুন। তাঁর হাত দিয়ে নিয়োগ পাবে উচ্চ শিক্ষিত এবং অপেক্ষাকৃত সম্মানজনক বেতনের শিক্ষক কর্মকর্তা। যদি এর অন্যথা ঘটে তা হলে স্থানীয় নেতাদের সম্ভবতঃ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার জো থাকবেনা।

এবার একটু তিক্ত অভিজ্ঞতা (অগ্রিম মাফ চেয়ে নিচ্ছি)। নিকট অতীতে আমাদের এলাকার একজনকে ঢাকার পাশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি’র দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তিনি পিএস হিসেবে এলাকার কাউকে নিলেন না। যদিও ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে থেকে নিয়োগ পাওয়া কিশোরগঞ্জের কয়েকজন যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মকর্তা কর্মরত ছিলেন। চার বছর দায়িত্ব পালনের পর দেখা গেল উনার
সময়ে আড়াই শতাধিক নিয়োগপ্রাপ্তর মধ্যে পিএস সাহেবের নিজ জেলা কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহের রয়েছেন দুইশতেরও একটু বেশি শিক্ষক- কর্মকর্তা-কর্মচারী। উনি এলাকার প্রতি কমিটেড থেকে ৪/৫ জন

পিয়ন দাড়োয়ান আর ৩য় শ্রেণীর ৩/৪ জন নিয়োগ দিয়ে ধন্য করেছেন এবং জন্মস্থানের দায় শোধ করেছেন। আরেকজন আমাদের জেলার পাশের লাগোয়া উপজেলায় বাড়ী, যিনি কিশোরগঞ্জ শহরে বড় হয়েছেন বলে জানা যায়। শিক্ষক আন্দোলনের জটিলতায় তাঁকেও অনেক আশা করে সরকার দায়িত্ব
দিয়েছিলেন। ঢাবি থেকে গিয়ে ২ মাসের মধ্যে ভিসি প্যানেল নির্বাচনে জিতার কারণে মহামান্য রাষ্ট্রপতি পুনরায় ভিসি নিয়োগ দিলেন। উনি পুনরায় নিয়োগ প্রাপ্তির মাত্র দু’মাসের মাথায় এবার নিজ বাস ভবনের বাইরে ঠাঁই নিলেন। ফলাফল, ২/৩ মাসের মাথায় বেক টু দি প্যাভেলিয়ান ! সো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেন পুনরায় না বলেন, আমরা কিশোর। কিশোরগঞ্জকে অনেক ভালোবেসেই নিজের বাবা তথা জাতির জনকের নামে এ বিশ্ববিদ্যালয় আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন। আমরা যেন উনার মর্যাদা বুঝতে সক্ষম হই।

[ লেখক: বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ]

Tags: