কিশোরগঞ্জের উজান এলাকায়ও এখন ভাসমান সবজি চাষ বেড়েছে। কৃষক-কৃষাণিদের কাছে ভাসমান সবজি আবাদ ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ভাসমান সবজি কৃষককে নতুন করে আশার আলো দেখিয়েছে। এই পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছরই আবাদ বাড়ছে। জেলা সদরের মহিনন্দ ইউনিয়নের কাশোরার চর বিল, চংশোলাকিয়া ও বত্রিশ এলাকা সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে ভাসমান সবজি চাষাবাদে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, ভাসমান সবজি চাষে সাধারণত কচুরিপানা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে হোগলা, সোলা, নলখাগড়া, বিভিম্ন ধরনের জলজ আগাছা, ধানের খড়, নাড়া, তুষ প্রভৃৃতিও ব্যবহার করা যায়। ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষে কোনো ধরনের সার বা সেচের প্রয়োজন হয় না। চাষ শেষে বেডটি জৈব সার হিসেবে জমিতে প্রয়োগ করা যায়। এটি একটি পরিবেশবান্ধব চাষাবাদ পদ্ধতি, যাতে অর্গানিক ফসল চাষ করা যায় এবং এ পদ্ধতিতে জেলেরা চাইলে একই সঙ্গে ফসল এবং মাছও চাষ করতে পারেন। কিশোরগঞ্জে ভাসমান বেডে আমন ধানের বীজতলা ও বিষমুক্ত সবজির আবাদ করা হচ্ছে। বন্যার পানি ও অতিবৃষ্টিজনিত জলাবদ্ধতায় ফসলহানির আশঙ্কা থাকে। তা থেকে রক্ষা পেতে কৃষকরা এভাবেই বিকল্প পদ্ধতির চাষাবাদে ঝুঁকে পড়ছেন। এতে বন্যা থেকে বীজতলা রক্ষা পাবে। অন্যদিকে এসব বেডে উৎপাদিত চারা অল্পদিনেই আমনের জমিতে রোপণের উপযোগী হবে। এর পাশাপাশি দিনে দিনে কিশোরগঞ্জে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ভাসমান বেডে বিষমুক্ত সবজির উৎপাদন। আর এভাবেই নদী ও বিলের পানিতে ভাসমান বেডে বীজতলা ও শাকসবজি আবাদ করে লাভের মুখ দেখছেন কৃষকরা। কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নে কাশোরারচর বিলে এমন ইতিবাচক চিত্রই দেখা গেছে। বিষমুক্ত থাকায় বাজারে এসব সবজির দাম ও কদর বেশি। স্বাভাবিক সবজির চেয়ে দাম বেশি থাকায় কৃষকরা বেশ লাভের মুখ দেখছেন। অনেকেই এ বিলে এসে দাম দিয়ে সবজি কিনে নিচ্ছেন। এই কাজে কিশোরগঞ্জের সদরের নিয়োজিত উপ-সহাকরী কৃষি কর্মকর্তারা চাষাবাদের কৌশল ও প্রয়োগের বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেছেন।
কাশোরারচর বিলের কৃষক ফয়েজ উদ্দিন জানান, এবার ভাসমান বীজতলার চারাও হয়েছে বেশ ভালো। এসব বীজতলায় কোনো সার ও কীটনাশকের প্রয়োজন পড়েনি। রঘুখালি পাঠানপাড়ার কৃষক আমিরুল ইসলাম রতন জানান, বন্যার কারণে আমনের বীজতলা প্রায় সময় নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য এবছর কৃষি বিভাগের পরামর্শে ভাসমান বীজতলা তৈরি করেছি। ভালো ফল পেয়েছি। তিনি আরও বলেন, বীজতলায় আলাদাভাবে কোনো সার ও পানি দিতে হয় না। বীজতলায় বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করবো। বন্যা আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আশা করছি, এবার লাভের মুখ দেখবো।
এসব ফসলের চাষাবাদের বিষয়ে উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা আলা উদ্দিন ও উম্মে কুলসুম জানান, এই প্রথম জেলা সদরের উজান এলাকায় আবদ্ধ জলাভূমিতে ভাসমান বীজতলা তৈরি করে কৃষক বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় খুঁজে পেয়েছে। আর বিষমুক্ত ভাসমান শাক-সবজি করে অনেকটা বেকারত্ব দূর হয়েছে। ভাসমান বীজতলা এবং ভাসমান সবজি চাষের প্রতি দিন দিন কৃষকের আগ্রহ বাড়ছে বলে উভয় কর্মকর্তা জানান।
সদর উপজেলা কৃষি অফিসার দিলরুবা ইয়াসমিন জানান, তিনটি প্রকল্পের মাধ্যমে সদরে ভাসমান সবজি আবাদ করা হয়েছে। ১. ভাসমান বেডে সবজি মসল্লা ও লতা জাতীয় ফসল উৎপাদন। ২. আপদকালীন ধানের চারা পাওয়ার লক্ষ্যে ভাসমান বীজতলা। ৩. গো খাদ্য ভাসমান বেডে যেমন নেপিয়ার, পাচচং, জার্মানি এবং পশুর ঘাস উৎপাদন করা হচ্ছে। আমনের বীজ ও অন্যন্যা বীজ কৃষি বিভাগ থেকে দেওয়া হচ্ছে। জেলা সদরে ৬০টি বেডে ২০জন কৃষক এসব ভাসমান সবজি আবাদ করেছেন। বেড গুলোতে এখন লাল শাক, কলমি শাক, পুইশাক, বরবটি, লাউ, ঢেড়স, মুলা, হলুদ বিদ্যমান রয়েছে। তিনি জানান, ভাসমান সবজি আবাদে ভূমিহীন কৃষকরা আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে। বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন ও পরিবেশ বান্ধব জলাভূমির ব্যবহার করা হচ্ছে। নিম্নাঞ্চল ও আবদ্ধ জলাভূমিতে এসব সবজি সহজে উৎপাদিত হচ্ছে। তিনি আরও জানান, নদী ও বিলের পানিতে কলা গাছের ভেলায় কচুরিপনা পচিয়ে এ বীজতলা করা হয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে প্রতিটি বেডে দেড় কেজি করে বিনা-৭ জাতের আমনের বীজ বপন করা হয়েছে। স্বাভাবিক জমিতে বীজ বপনের ২৫ থেকে ৩০ দিনের মতো সময় লাগে জমিতে চারা রোপন করতে। অথচ ভাসমান বেডে উৎপাদিত চারা ১০ থেকে ১২ দিন পরেই জমিতে লাগানোর উপযোগী হয়। এতে সময়ও বাঁচে। খরচও কম। সেইসঙ্গে তা পরিবেশবান্ধব।
জেলা সদরে উজান এলাকায় এসব ভাসমান সবজি আবাদের খবর পেয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা একাধিকবার পরিদর্শনে এসে আশ্চার্যান্বিত হয়েছেন। সবজি আবাদে সন্তোষ প্রকাশ করেছন। সর্বশেষ পরিদর্শনে এসছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোশাররফ হোসাইন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সাবেক সচিব ড. এস এম নাজমুল ইসলাম, কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক কৃষিবিদ চৈতন্য কুমার দাস, ঢাকা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ ড. আব্দুল মুঈদ, ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম, সাবেক ডিজি মুকুল চন্দ্র রায়, জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( সার্বিক) তরফদার মোঃ আক্তার জামীল, সাবেকইউএনও আবু নাছের বেগ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. সফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত উপপরিচালক (শষ্য) ড মোঃ সাইফুল ইসলামসহ কয়েক জেলার প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিকগণ।
এসব সবজি চাষীরা তাদের শষ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকারের স্বীকৃতি চেয়েছে।