কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার ৫নং দামিহা ইউনিয়নের নগরকূল গ্রামের শ্রী সুভাষ চক্রবর্তীর বড় ছেলে বি.বি.এ (অনার্স) শেষ বর্ষের ছাত্র সুব্রত চক্রবর্তী। পড়াশুনার পাশাপাশি এলাকার শিশু ও বয়জৈষ্ঠদের নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিকতা শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন বিগত তিন বছর যাবত। এককভাবে নিজ উদ্যোগে ধর্মীয় চিন্তা চেতনা ও নৈতিকতা শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সুব্রত চক্রবর্তী। নগরকুল গ্রামে শ্রীশ্রী রাধামদন গোপাল জিউর মন্দির সংলগ্ন নিজ বাড়ী হওয়ায় ঐ মন্দিরেই আগত ভক্তবৃন্দের নিকট ধর্মীয় পাঠশালার ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করলে সকলেই সহযোগীতার আশ্বাস দেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি পৌরহিত্য করা সুব্রত আসায় বুক বাধেন আগামীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের। বিগত তিন বছর পূর্বে একক প্রচেষ্টায় মৌখিকভাবে এলাকার ৮০ জন প্রাথমিক সদস্য নিয়ে অনানুষ্ঠানিক ভাবে গড়ে তোলেন শ্রীশ্রী গীতা সাধনা সংঘ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। শুরু হয় পথচলা। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করেন সনাতন ধর্মের শিশু শ্রেণীর শিক্ষার্থী। প্রথমে ১০ জন নিয়ে শুরু করলেও বর্তমানে সুব্রতর পাঠশালায় শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। সপ্তাহে একদিন অর্থাৎ প্রতি শুক্রবার এককভাবে সকাল ১০টা থেকে ১টা পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে ধর্মীয় ও নৈতিকতা শিক্ষা দিয়ে আসছেন সুব্রত। বাংলাদেশ সংস্কৃত ও পালি শিক্ষাবোর্ড থেকে কাব্যতীর্থ ও স্মৃতিতীর্থ পাশ করা সুব্রতর পাঠশালায় ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। একক প্রচেষ্টায় সুব্রত একাই শিক্ষক হিসাবে এলাকায় সুনাম ছড়ানোর পর আনুষ্ঠানিকভাবে বিগত ১৩ই জুলাই’১৮খ্রী: এলাকার লোকজন নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, মন্দিরের বারান্দায় অর্ধ শতাধিক শিশু সুরেলাকণ্ঠে বিভিন্ন দেব-দেবীর মন্ত্রোচ্চারণ করছেন। সে এক ভিন্ন পরিবেশ। ছোট ছোট শিশুদের পরম ¯েœহে পাঠদান করে যাচ্ছেন সুব্রত। নগরকুলের নিখিল পালের তিন বছরের মেয়ে অপর্ণা রানী পালকে স্বরস্বতী দেবীর মন্ত্র বলার সাথে সাথেই দাঁড়িয়ে দু’হাত একত্রিত করে এক পলকেই বলে দিলো অপর্ণা। অথচ অপর্ণা ভালোকরে কথাই বলতে পারে না। তেমনেই অপর্ণার মতো একই গ্রামের মৃত অঞ্জন ভৌমিকের মেয়ে রাজশ্রী ভৌমিক (৩), নিখিল সরকারের ছেলে শিপন চন্দ্র সরকার (৪), স্বপন সরকারের ছেলে প্রিন্স সরকার (৪) একই ভঙ্গিমায় বিভিন্ন দেবদেবীর মন্ত্র নির্ভুল ও নিখুঁত ভাবে উচ্চারণ করে যাচ্ছে। সুব্রত’র শিক্ষাদানে সম্মোহিত হয়ে যায় সবাই। সুব্রত যা বলে তাই করে দেখায় শিক্ষার্থীরা। শিশু শ্রেণি সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত তারপর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত বয়স্কদের জন্য। শিশুদের পাঠদান শেষে কথা হলে সুব্রত জানান, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার পাশাপাশি ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্যই প্রতি শুক্রবার অবসর সময়টা আমি শেয়ার করি গ্রামের সনাতন ধর্মের শিশু-কিশোর ও বয়স্কদের মাঝে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদগীতা থেকে প্রতিমাসে একবার গোসাই এনে বয়স্কদের মাঝে গীতাপাঠ ও ধর্মীয় আলোচনা করেন সুব্রত চক্রবর্তী। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদগীতা থেকে চুম্বক অংশ তুলে এনে নিজ উদ্যোগে ১৬পৃষ্টার বাংলা অনুবাদসহ ছোট্ট বই আকারে ফটোকপি করে প্রত্যেক শিশু শিক্ষার্থীদের দান করেন সুব্রত। কার অনুপ্রেরণায় এসব করছেন প্রশ্ন করলে সুব্রত জানান, স্কুল-কলেজগামী শিশু কিশোররা ধীরে ধীরে বিপথগামী হতে দেখে নিজেই একদিন সিদ্ধান্ত নেন ধর্মীয় ও নৈতিকতা শিক্ষার এই পাঠশালার। তাছাড়া স্ট্রোক এর রোগী সুব্রত’র বাবা সুভাষ চক্রবর্তী সাহস যুগিয়েছেন তাঁকে। বসত ঘরের বারান্দায় একটি চেয়ারে বসে বাবা সুভাষ চক্রবর্তী প্রত্যক্ষ করেন ছেলে সুব্রত চক্রবর্তীর শিক্ষাদান। এলাকায় ২/৩টি টিউশনি এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌরহিত্য করে যা পাওয়া যায় তার অর্থেই চলে সুব্রতর পাঠশালা। নগরকুল গ্রামের নিতিশ সরকার একটি ব্ল্যাকবোর্ড, ছোটন সরকার খাতা-কলম এবং স্বপন সরকার শিশুদের জন্য চকলেট জুস দিয়ে সাহায্য করেছেন।
মন্দিরের বারান্দায় গাদাগাদি করে পড়াতে হয় সুব্রত-কে। মন্দিরের আঙ্গিনায় একটি রচনাঘর নির্মাণ খুবই জরুরী। অর্থাভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। রোদ-বৃষ্টি-খড়া যাই হোক মন্দিরের খোলা বারান্দাতেই কষ্ট সহ্য করে পড়াতে হয় সুব্রত-কে। সুব্রত আশা করেন তার পাঠশালা একদিন দেশের সকল মানুষের প্রশংসা কুঁড়াবে। সমাজের মধ্যবিত্ত, ধনী এবং সরকারি-বেসরকারি সাহায্য সংস্থা থেকে আর্থিক অনুদান পেলে সুব্রত’র পাঠশালা একটি রোল মডেল হয়ে থাকবে বলে জানান এলাকার লোকজন।