আমি নিছার আহমদ। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ৫ নং সেক্টরের সাব সেক্টর সুনামগঞ্জের ‘ডি কোম্পানি’র উপ-অধিনায়ক ছিলাম। আমাদের ‘ডি কোম্পানি’র সদরদপ্তর ছিল রতারগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যা ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বালাট বর্ডার থেকে বাংলাদেশের তিন কিলোমিটার অভ্যন্তরে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমার্ধে রতারগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমরা ‘ডি কোম্পানি’র সদরদপ্তর স্থাপন করি। তারও দুই কিলোমিটার দক্ষিণে সালবন ও নামা সালবন নামক স্থানে আমরা বাঙ্কার খনন করে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হই।

আমাদের বাঙ্কার হইতে ঝিলের ওপারে ৪০০ গজ দক্ষিণে পাক সেনাদের বাঙ্কার ছিলো। দিনের বেলায় তেমন যুদ্ধ বা গোলাগুলি হতনা। রাত গড়ালেই শুরু হয় যুদ্ধ। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা ৫ টি প্লাটুন ও ১৫ টি সেকশনে বিভক্ত হয়ে মোট ১৫ টি বাঙ্কার তৈরি করি এবং এতে দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়। সন্ধ্যার পূর্বে বাঙ্কারে বসে রাতের খাবার শেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বাঙ্কার হতে ৪-৫ রাউন্ড গুলি পাক সেনাদের অবস্থানের উপর ফায়ার করা হয়। এরপর পাক সেনাদের পালা। আমাদের বাঙ্কারের উপর তারা সারা রাত ব্রাশফায়ার করে। ভোর হলেই যুদ্ধ শেষ হয়। উল্লেখ্য, মুক্তিযোদ্ধাদের খুবই হিসেব করে গুলি খরচ করতে হতো।

৪ঠা অক্টোবর খুব ভোরে আমাদের কোম্পানি কমান্ডার মরহুম হাবিলদার মোঃ জালাল উদ্দিন ভারতের বালাটে যুদ্ধের অগ্রগতি সংক্রান্ত কনফারেন্সে চলে যায়। অপরদিকে আমিও উপ-অধিনায়ক হিসেবে সহযোদ্ধা নাসিরকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধের রণকৌশলের পরবর্তী নির্দেশনা সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের জানাতে সালবন ও নামা সালবনের বাঙ্কারের দিকে রওনা দেই। তখন আমার সাথে একটি সাব মেশিনগান (এস এম জি), কোমরে গামছায় বাঁধা পাঁচটি অতিরিক্ত মেগজিন যার প্রতিটিতে ৩৪ রাউন্ড করে গুলি ভর্তি ও নাসিরের সাথে একটি এসএলআর, এক মেগজিন গুলি এবং অতিরিক্ত ১০০ রাউন্ড গুলি বেল্টে করে কোমরে বাঁধা।

আনুমানিক ভোর সারে ৬ টার দিকে আমাদের বাঙ্কার হইতে ৩০০ গজ দুরে থাকা অবস্থায় দেখি পাক বাহিনী আমাদের বাঙ্কারে আক্রমণ করে দখলের চেষ্টা করছে। আর এদিক থেকে বাঙ্কারে অবস্থানকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বাঙ্কার রক্ষার জন্য প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। অর্থাৎ পাক সেনারা রাতে ঝিল পাড় হয়ে আমাদের বাঙ্কারের কাছাকাছি জায়গায় অবস্থান নেয় এবং সকালে সুপরিকল্পিত ভাবে আমাদের বাঙ্কারের উপরে আক্রমণ করে।
অবশেষে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়ে আত্নরক্ষার্থে গুলি ছুড়তে ছুড়তে ধান খেত ধরে পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং পালিয়ে বর্ডারের দিকে চলে যায়। ইতিমধ্যে পাক সেনারা বাঙ্কার দখলে নিয়ে বাঙ্কারের উপরে উঠতেই আমি এবং আমার সহযোদ্ধাকে দেখে ফেলে। দেখা মাত্রই আমাদের দিকে ব্রশফায়ার ছুরতে থাকে। আমরা তখন ৩০০ গজ অর্থাৎ তাদের কিলিং রেঞ্জের মধ্যে অবস্থান করছি। প্রথমে কয়কটা গুলি আমার পায়ের ফাক দিয়ে চলে যায় এবং ভাগ্যিস প্রাণে বেঁচে যাই। আমরা তাৎক্ষণিক ধান খেতে শুয়ে পরি। তাদের গতি থামানোর জন্য আমার সাব মেশিনগান (এস এম জি) এবং নাসিরের এসএলআর হতে কয়েক রাউন্ড গুলি তাদের অবস্থানের উপর নিক্ষেপ করি। তখন পাকিস্তানিদের গতি থেমে যায়। তারা হয়তো ভেবেছে ৪ ফুট উচু ধান খেতে আমরা অনেকেই উৎ পেতে আছি। তখন পাকিস্তানিরা কৌশল পরিবর্তন করে আমাদের জীবিত ধরার চেষ্টা করে। আমরাও কৌশলে ধান খেতে নড়াচড়া না করে আল ঘুরিয়ে ক্রলিং করে পিছু হটতে থাকি। প্রায় ১ কিলোমিটার আসার পর সামনে পাহাড়ী ছড়ার পারে এসে ছরায় ঝাপ দেয়ার আগে দেখতে পাই আমাদের পরনের প্যান্ট সব ভিজা। কিভাবে কখন প্রস্রাব হলো মোটেই টের পেলাম না। এরপর একটু দাড়িয়ে আমরা পাহাড়ী ছরায় ঝাপ দেই। তখন পাক সেনারা আমাদের দেখতে পেয়ে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এতে সামনে থাকা বাশ ঝারটি থেঁতলে যায় এবং তাদের অগ্রগতি থেমে যায়। আমরা এই ছরা ধরে ক্যাম্পের দিকে যেতে থাকি। এমতাবস্থায় পাক বাহিনী আমাদের গতিবিধি বুঝতে পেরে এডভান্স হয়ে গুলি করতে করতে আমাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আমরাও মাঝেমধ্যে ২-১ টা ফায়ার করে তাদের জবাব দেই। কিন্তু ছরার পাশের আঁখ খেতের শুকনো পাতার সাথে গুলির ঘর্ষণের বিকট শব্দে আমাদের বুক কেপে উঠে। আমরা ৩০ মিনিটের মধ্যে ক্যাম্পে পৌছাই। তখন বুঝতে পারি শতাধিক পাক সেনা আমাদের সদরদপ্তর দখলে নেয়ার জন্য গুলি করতে করতে এদিকে এগিয়ে আসছে। ক্যাম্পে গিয়ে ৩ জন সহযোদ্ধা’সহ আমরা মোট ৫ জন অস্র ও গোলাবারুদ নিয়ে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার জন্য ভারতের বর্ডারের দিকে রওনা দেই। এমন সময় গ্রামের স্থানীয় সুবিধাবাদী কিছু লোক আমাদের গতি রোধ করে। তখন আমি তাদের মাথার উপর দিয়ে ফাকা গুলি নিক্ষেপ করতেই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পরে। ইতিমধ্যে পাক সেনাদের গুলি আমাদের সদরদপ্তরে প্রবেশ করতে থাকে। তখন তাকিয়ে দেখি আমাদের দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার দুপুরের খাবারের ভাত, তরকারীগুলো মনে হচ্ছে অসহায় দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

আমরা পুনরায় সংগঠিত হয়ে আবার আক্রমনের জন্য বর্ডারের দিকে অবস্থান নেই এবং ভারতীয় কমান্ড ও বাংলাদেশের সাব সেক্টর কমান্ড থেকে নির্দেশ আসে আজই যেকোন মূল্যে সদরদপ্তর পুনর্দখল করতে হবে এবং এর পাশাপাশি আমাদের কাছে পর্যাপ্ত গোলাবারুদ সরবরাহ করে।

পরবর্তীতে এইদিন বিকেলে কোম্পানি কমান্ডার সহ আমরা ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা গোলাবারুদ নিয়ে সুসজ্জিত হয়ে আমাদের সদরদপ্তর পুনর্দখলের উদ্দেশ্যে ২ কিলোমিটার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি। মথুরকান্দি নামক বাজার পার হতেই আমরা পাক সেনাদের মুখোমুখি হয়ে যাই। পাক সেনারা আমাদের দেখতে পেয়ে তাৎক্ষণিক ভাবে পাহাড়ি ছরার পারে পজিশন নেয় এবং আমরাও তাদের উল্টো দিকে ছরার অপরপাশে পজিশন নেই। তখন আমাদের দুই বাহিনীর দুরত্ব মাত্র ১০০ ফিট। এরপর শুরু হয় দুপক্ষের অনবরত গুলিবর্ষণ। আমাদের অবস্থান সড়ক থেকে ২ ফিট নিচে আর তাদের অবস্থান ৪ ফিট নিচে থাকায় তাদের গুলিতে মাটির দলা এসে আমাদের শরীরে পরতে থাকে। তাতে আমরা জীবন্ত কবরে যাওয়ার অবস্থা। ১ ঘন্টা গোলাগুলির পর পাক সেনাদের গুলি শেষ হয়ে গেলে তারা পালিয়ে যায়। তখন গ্রামের মানুষ বাঙ্কার থেকে চিৎকার করে আমাদের জানায় পাক সেনারা পালিয়ে যাচ্ছে। ততক্ষণে তারা আমাদের ফায়ারিং রেঞ্জের বাইরে চলে যায়। এভাবেই আমরা মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সদরদপ্তর পুনরায় দখল করি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নিছার আহমদ
উপ-অধিনায়ক
ডি কোম্পানি, ৫ নং সাব সেক্টর সুনামগঞ্জ
সম্পাদক ও প্রকাশক
মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠ ডটকম