বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ১৫ নভেম্বর শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে তা ভেস্তে গিয়েছে। রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে আপত্তি জানায় নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ও নাগরিকত্ব না পাওয়ার শঙ্কার কথা বলে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে, টেকনাফের উনচিপ্রাং ক্যাম্পে বিক্ষোভ করেছে শত শত রোহিঙ্গা। তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি নয়। এ অবস্থায় অনিশ্চয়তার মুখে পড়ল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া।
গত অক্টোবরে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, প্রথম দফায় দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে রাখাইনে প্রত্যাবাসন শুরুর কথা ছিল বৃহস্পতিবার। মিয়ানমারের কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে প্রস্তুত ছিলেন। তবে বাংলাদেশ বলছে, জোরপূর্বক কাউকে ফেরত পাঠানো হবে না। তালিকাভূক্ত রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরতে চায় কি-না তা নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের মাধ্যমে নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসারে নির্ধারিত হয়, নৌপথে একটানা ১৫ দিন রোহিঙ্গাদের প্রথম ব্যাচের ২ হাজার ২৬১ জন মিয়ানমারে ফিরে যাবে। কক্সবাজারের একাধিক শিবির থেকে প্রতিদিন ১৫০ জন করে রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেবে মিয়ানমার। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী প্রত্যাবাসনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে বাংলাদেশ। তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে তাদের পরিবহণের জন্য বাসের ব্যবস্থা করা হয় যা উখিয়ার আমতলী টেকনাফের উনচিপ্রাং ক্যাম্পে রাখা ছিল।
প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথাও বলেছেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, প্রত্যাবাসনের জন্য ঘুমধুম পথ ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত ছিল তাদের। রোহিঙ্গাদের জন্য তিন দিনের রেশনসহ সব কিছু প্রস্তুতও ছিল। কিন্তু দুপুরে হঠাৎ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে রোহিঙ্গারা। পাঁচ দফা দাবি জানিয়ে নিজ দেশে ফেরত যেতে অস্বীকার জানিয়েছে তারা।
তাদের বক্তব্য যে পাঁচ দফা দাবি রয়েছে, তা পূরণ হলেই দেশে ফিরে যাবে। তারা সঠিক নিরাপত্তা চায়। তারা মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের বিশ্বাস করে না। মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে পরিচয় পত্র দিতে জাতিসংঘকে অনুরোধ করেছে তারা। ফলে প্রত্যাবাসনের গোটা প্রক্রিয়া এখন অনিশ্চয়তায় পড়ে গেল। যদিও প্রত্যাবাসনের বিষয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আপত্তি ছিল। জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলো রোহিঙ্গাদের পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা এবং পুনর্বাসনের যথাযথ প্রস্তুতি নিশ্চিত করে প্রত্যাবাসন শুরু করার কথা বলেছিল।
বাংলাদেশকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গা নাগরিকদের বসবাসের জন্য ভারত সরকার ২৮৫টি বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছে। আর চীন সরকার এক হাজার বাড়ির কাঠামো পাঠিয়েছে, যেগুলো সংযোগ করলেই পূর্ণ বাড়িতে রূপ নেবে। আশা করা হয়েছিল প্রথম ব্যাচের প্রত্যাবাসন শুরু হলে ধারাবাহিকভাবে বাকি রোহিঙ্গারাও ফিরে যাবে। এখন রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে সম্মত না হওয়ায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ফের কবে নাগাদ শুরু করা সম্ভব হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিল।
রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে না চাওয়ার বিষয়ে যেসব দাবি করেছে তা প্রণিধানযোগ্য। তাদের নিরাপত্তা, পরিবেশ ও কর্মের নিশ্চয়তা প্রদান করা প্রয়োজন। নিজ দেশে সব ধরনের অধিকার যেন রোহিঙ্গারা ফিরে পায়, সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। তাদের প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দিতে হবে।
আমরা মনে করি দেশে ফিরে গিয়ে রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে ও সসম্মানে থাকতে পারে সে জন্য মিয়ানমারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এটি মিয়ানমারের নৈতিক দায়িত্ব। তাদের নাগরিকত্ব নিয়ে কোনো ধরনের চালাকি করা চলবে না। রোহিঙ্গাদের মধ্যে এ আস্থা জাগাতে হবে যে তারা তাদের মর্যাদা ফিরে পাবে। আর এসব বিষয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের।