করিমগঞ্জ-তাড়াইল এর আসনটিতে দুই জোটের দু প্রার্থীর মধ্যেই হবে মূল প্রতিদ্বন্ধিতা। তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় মেতেছে দলীয় নেতা কর্মী ও সাধারণ জনতা। কে হবেন বিজয়ী সেদিকেই দিকেই তাকিয়েই প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন দিনরাত। দু জোটেই দলীয় কোন্দল ও ভেদাভেদ ভুলে এখন চলছে তুমুল নির্বাচনী প্রচারণা। দু জোটের প্রার্থীকে দলীয় নেতারা সমর্থন জানিয়ে ভোটারের দ্বারে দ্বারে ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন এবং ভোট চাইছেন।
কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসনে নৌকার প্রার্থী বিশিষ্ট শিল্পপতি তরুন রাজনীতিবিদ এরশাদ উদ্দিন ,মহাজোটের প্রার্থী শ্রম ও কর্মসংস্থাপন প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুকে আনুষ্ঠানিকভাবে লাঙ্গল প্রতীকে সমর্থন করলেন। শনিবার রাতে করিমগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের রোহা গ্রামে আয়োজিত নির্বাচনী জনসভায় এ সমর্থন করেন। এতে সভাপতিত্ব করেন আফতাব উদ্দিন ভূইয়া। প্রধান অতিথি ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থাপন প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু এমপি। প্রধান আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ মিলস্কেল বি-প্রসেস অ্যান্ড এক্সপোর্টাস এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহ সভাপতি শিল্পপতি এরশাদ উদ্দিন। বক্তব্য রাখেন আওয়ামীলীগ নেতা মামুন চৌধুরী, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন দীদার সহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। পথসভাটি শীতের রাতে কুয়াশার ভেতরেও হলেও পরে হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে জনসভায় রুপ নেয়।
এই আসনে নৌকার হাল ধরতে সাবেক দুবারের এমপি ড.মিজানুল হক, জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহ সভাপতি বিশিষ্ট শিল্পপতি ও সমাজ সেবক আলহাজ্ব এরশাদ উদ্দিনসহ আরও কতজন দলীয় মনোনয়ন ফরমও কিনেছিলেন। আওয়ামীলীগের ঘাটি হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামীলীগ মহাজোটে নির্বাচনে যাওয়াতে এই আসনটি ছাড় দিতে হয়েছে।
বর্তমান সংসদ সদস্য হলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. মজিবুর হক চুন্নু। বিগত নির্বাচনে তিনি মহাজোটের পক্ষ থেকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই আসনে দলীয় প্রার্থী না দেওয়ায় আওয়ামীলীগের দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করে। এই ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা লাঙলের বোঝা বইতে চেয়েছিলেন না। লাঙলকে প্রতিহত করার লক্ষে সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন করে এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার জোর দাবি জানিয়েছিলেন তারা। দলীয় প্রতীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমি এবার অষ্টমবারের মতো প্রার্থী হয়েছি। সাতটি নির্বাচন করে আমি চারবার জয়লাভ করেছি। এ আসনে নৌকার ১৯ জন প্রার্থী ছিলেন। তারমধ্যে অন্যতম একজন এরশাদ উদ্দিন এ পথসভায় উপস্থিত রয়েছেন। আপনারা মনোনয়ন কেন পাননি এ নিয়ে আমার সাথে রাগ করবেন না। আওয়ামীলীগের ভাইয়েরা রাগ করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে করবেন। আর কেনই বা রাগ করবেন, কেনই বা আপনারা মনোনয়ন পাননি সেটাও লক্ষ রাখবেন। নৌকা মার্কার দল এখন ক্ষমতায় আর সে নৌকায় ভোট দিতে পারবেন না আপনারা এতে করে যেমন কষ্ট আছে। তেমনি নৌকার মালিক বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও কষ্ট আছে। তিনি সারা দেশে ৬১টি আসনে নৌকার প্রার্থী দিতে পারেননি। এ কারণে তাঁর মনে অনেক কষ্ট থাকা সত্ত্বেও দেশের স্বার্থে উন্নয়নের স্বার্থে এ ত্যাগ করেছেন। তাই আমাকে আবারো সমর্থন করুন লাঙল প্রতীকে ভোট দিয়ে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে আসার সুযোগ করে দিন।
প্রধান আলোচকের বক্তৃতায় নৌকার কান্ডারি এরশাদ উদ্দিন বলেন, গত এক দশক ধরে তৃণমূল পর্যায়ে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে দলীয় ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করে তৃর্ণমূল নেতা কর্মীদের চাঙ্গা রেখেছি। করিমগঞ্জ-তাড়াইলের বিধবা, বয়স্ক ভাতা চালু, সুতারপাড়া ইউনিয়নের রাঙ্গামাটিয়া ও পাঙ্গাইয়া খালেল উপর দুটি ফসল রক্ষঅর বাঁধ তৈরি ,গৃহহীনদের মাঝে ডেউটিন ও গৃহনিমার্ণ সামগ্রী বিতরণ, প্রতি বছর ঈদও পূজায় গরবি নারী-পুরুষের মাঝে শাড়ি ও লুঙ্গি বিতরণ করে আসছি। অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের মাঝে সেলাই মেশিন বিতরণ ও বন্যায় ক্ষতিগস্থদের মাঝে খাদ্য সামগ্রী ছাড়াও বীজ ও কীটনাশক বিতরণ, প্রতিবছর মসজিদ, মন্দির ও ম্জাারের জন্য উন্নয়নের জন্য অনুদান দিয়ে যাচ্ছি। আসুন মহাজোটের প্রার্থীকে লাঙল প্রতীকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করি।
করিমগঞ্জ ও তাড়াইল উপজেলা নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে বিগত দশটি নির্বাচনের মধ্যে ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনসহ মাত্র দুইবার বিএনপি এই আসনে জয়ের স্বাদ পায়। বাকি আটটি নির্বাচনের মধ্যে একবার স্বতন্ত্র, তিনবার আওয়ামী লীগ এবং সর্বোচ্চ সংখ্যক চারবার জাতীয় পার্টি এই আসনটি নিজেদের দখলে নেয়।
এই চার বারই জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন মো. মুজিবুল হক চুন্নু। এর মধ্যে অবশ্য ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি লড়েছেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট প্রার্থী হিসেবে এবং সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েও শেষ মুহূর্তে প্রত্যাহার করে নেয় আওয়ামী লীগ। বিগত দু’টি নির্বাচনের মতো এবারের নির্বাচনেও জোটগত ঐক্যের কারণে এ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেয়নি। মহাজোট প্রার্থী হিসেবে এখানে নির্বাচনে লড়ছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি দলীয় প্রতীক ‘লাঙ্গল’ নিয়েই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
অন্যদিকে বিএনপিও তাদের দলীয় কোন প্রার্থী দেয়নি এই আসনটিতে। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাবেক বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা ড. এম ওসমান ফারুককে দিয়ে আসনটিতে বিজয়ীর হাসি হাসে বিএনপি। এবারের নির্বাচনেও সাবেক এই শিক্ষামন্ত্রীর প্রার্থী হওয়ার কথা ছিল। আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটুকু ছাড়া এই আসনে ড. এম ওসমান ফারুকের প্রার্থিতা ছিল অনেকটাই নিশ্চিত। এ রকম পরিস্থিতিতে ২০১৬ সালের ৪ঠা মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান এম সানাউল হক একাত্তরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থাকাকালে ড. এম ওসমান ফারুক স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত করছে বলে জানান। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ওঠার পর থেকেই ড. এম ওসমান ফারুক আত্মগোপনে চলে যান। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. এম ওসমান ফারুকেরে এই আসনে জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট জালাল মোহাম্মদ গাউস ও করিমগঞ্জ উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম সুমন এই দু’জনকে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। পরবর্তিতে তাঁদের বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্টের চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) প্রার্থী শিক্ষাবিদ ও কৃষিবিদ ড. মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম এর হাতে ‘ধানের শীষ’ প্রতীক তুলে দেয়া হয়েছে। এতে করে বিএনরি মধ্যে ভেদাভেদ থাকলেও সম্প্রতি করিমগঞ্জ উপজেলা বি,এন,পির সাবেক সভাপতি রফিকুর রহমান রফিক ও জাহাঙ্গীর মোল্লা এবং বর্তমান সভাপতি আজিজুর রহমান দুলালের নেতৃত্বে পথসভা করে একাট্টা হয়েছে।
এছাড়া এ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রার্থী মো. আলমগীর হোসাইন (হাতপাখা), সিপিবি প্রার্থী ডা. এনামুল হক ইদ্রিছ (কাস্তে), গণতন্ত্রী পার্টির প্রার্থী দিলোয়ার হোসাইন ভূঁইয়া (কবুতর) এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) প্রার্থী মো. শওকত আলী (মশাল) প্রতীকে ভোটযুদ্ধে লড়াই করছেন।
সবকিছু মিলিয়ে করিমগঞ্জ-তাড়াইল এর আসনটিতে দুই জোটের দু প্রার্থীর মধ্যেই হবে মূল প্রতিদ্বন্ধিতা। তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় মেতেছে দলীয় নেতা কর্মী ও সাধারণ জনতা। কে হবেন বিজয়ী সেদিকেই তাকিয়ে আছেন তারা।