স্পোর্টস ডেস্কঃ বার্ষিকী পালনের রীতিতে আগ্রহ নেই তাঁর। জন্মদিন কিংবা বিবাহবার্ষিকীতে তাই কেক-টেক কাটার প্রশ্নই ওঠে না। তবে উৎসাহ থাকলে উৎসবের আবহে অন্য রকম এক বর্ষপূর্তির কেক কাটতে পারতেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। অধিনায়ক হিসেবে এই দফা মাঠের ক্রিকেটে পথচলা শুরুর এক বছর পেরোবে যে সপ্তাহখানেক পর! ২১ নভেম্বর।
এক হিসাবে সেই বর্ষপূর্তি হয়ে গেছে ৩০ সেপ্টেম্বর। ২০১৪ সালের ওই তারিখেই তো মুশফিকুর রহিমের কাছ থেকে ওয়ানডে নেতৃত্ব কেড়ে নিয়ে সঁপে দেওয়া হয় মাশরাফিকে! তবে সেনাপতি হিসেবে এ দফায় বাংলাদেশের ক্রিকেট-ব্রিগেড নিয়ে প্রথম মাঠে নামেন তিনি ২১ নভেম্বর। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচ দিয়ে। আজ সেই অভিন্ন প্রতিপক্ষের সঙ্গে টি-টোয়েন্টি দিয়ে শেষ হচ্ছে মাশরাফির অধিনায়কত্বের প্রথম পূর্ণ বছর। তাতে নিঃসন্দেহে পাস তিনি লেটার মার্কসসহ।
শীতের ঝরাপাতার বিবর্ণতা পেছনে ফেলে বাংলাদেশ ক্রিকেটে আবার শিমুল-পলাশের রং লাগে যে মাশরাফির বসন্ত-বাতাসে! তাঁর অধিনায়কত্বের জাদুকাঠির স্পর্শে!
২০১৪ সাল বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য ছিল ক্রান্তিকালের বছর। দুঃসময়ের আবর্তে ঘুরপাক ক্রমাগত, দুঃস্বপ্নের চোরাবালিতে তলিয়ে যাওয়ার জোগাড় ক্রমশ। আফগানিস্তান-হংকংয়ের মতো এলেবেলেদের কাছেও যে হারে বাংলাদেশ! এলোমেলো সেই দলকে কক্ষপথে ফেরানোর জন্য যুগান্তকারী পথে হাঁটে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। প্রথমবারের মতো টেস্ট ও সীমিত ওভারের ফরম্যাটের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয় আলাদা অধিনায়ক। মুশফিককে টেস্ট নেতৃত্বে রেখে সীমিত ওভারে ফেরানো হয় মাশরাফিকে। ৩০ সেপ্টেম্বরের বোর্ড সভা শেষে ওই সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময় বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান হাহাকারের সুরে যোগ করেন, ‘মাশরাফির ইনজুরি সমস্যার কথা আমরা সবাই জানি। তাই আপাতত জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের অধিনায়ক ও। নইলে বিশ্বকাপ পর্যন্ত করা হতো।’
অমনটা বলবেন না কেন বিসিবি সভাপতি? ইনজুরির সঙ্গে মাশরাফির বৈরিতা যে চিরকালীন! আর তিনি অধিনায়ক হলে তো কথাই নেই। শ্বাপদ ইনজুরির থাবা বসাতে তর সয় না যেন। ২০০৯ সালে মোহাম্মদ আশরাফুলের উত্তরসূরি হিসেবে জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে গেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজে। কিংসটাউনে প্রথম টেস্টেই হাঁটুর ইনজুরির শিকার। ধকল সামলে চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় দলে ফেরেন মাশরাফি। ২০১০ সালে ইউরোপ সফরে আবার পান নেতৃত্ব। ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ডে ভালোই ছিলেন তো! কিন্তু সেই সময় দীর্ঘায়িত হলো না খুব। দেশে ফেরার পর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচে আবার ইনজুরিতে পড়ে যান ছিটকে। এর পর থেকে খেলোয়াড় মাশরাফির নিরন্তর সংগ্রামের গল্পে ভরে উঠতে থাকে ক্রিকেট-উপাখ্যান। তাতে অধিনায়কত্বের পৃষ্ঠা সংযোজন নিয়ে আর ভাবার সময় কই!
২০১৪ সালে এসে ভাবতে হয় আবার। বছরজুড়ে পারফরমেন্সের গ্রাফ নিম্নমুখী থাকায় নেতৃত্ব বদলের ঝুঁকিটা নেয় বিসিবি। সেই ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়ে যায় মাশরাফির ইনজুরি-রেকর্ডের কারণে। কিন্তু সময়ে সেটি কী ফলদায়ী হিসেবেই না প্রমাণিত! গত এক বছরে মাশরাফির নেতৃত্বে যে দু’কূল উপচানো সাফল্য- এমন কিছু যে আগে কখনো দেখেনি বাংলাদেশ ক্রিকেট!
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ ৫-০ ব্যবধানে জিতে শুরু। এখন সেটি মনে হতে পারে ‘এ আর এমন কী’- তবে ওই সিরিজের আবহ বিবেচনায় তা ভীষণ কৃতিত্বের। এরপর বিশ্বকাপের বিস্ময় হয়ে মাশরাফির দলের কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তরণ। চমকের শেষ নয় এখানে। দেশে ফিরে ১৬ বছরের অজেয় পাকিস্তানের বিপক্ষে তিন ওয়ানডের সিরিজ জেতে বাংলাদেশ ৩-০ ব্যবধানে। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও ওড়ে প্রথম সিরিজ জয়ের আনন্দঘুড়ি। এরপর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আবার ৩-০। সব মিলিয়ে এ সময়ে যে ২১ ওয়ানডেতে দলকে নেতৃত্ব দেন মাশরাফি, জয় আসে ১৭টিতেই। অর্থাৎ ৮০ শতাংশের বেশি ওয়ানডে মাশরাফির এই দফা অধিনায়কত্বে জেতে বাংলাদেশ। অবিশ্বাস্য বললে তো আসলে কিছুই বলা হয় না! আর আগের নেতৃত্বকাল ধরলে সব মিলিয়ে ২৮ ওয়ানডের মধ্যে ২০টিতেই বিজয়ের মুকুট তাঁর দলের। শতকরা ৭১.৪২ ভাগের সাফল্যহারে সর্বকালের সেরা ওয়ানডে অধিনায়কদের ছোট্ট তালিকাতেও থাকবেন তাই মাশরাফি।
গত এক বছরে ৫০ ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশকে সমীহ জাগানিয়া শক্তিতে রূপান্তরিত করেছেন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’। এবার টি-টোয়েন্টির সাফল্য-স্টেশনে পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ মাশরাফির। পাকিস্তানের বিপক্ষে এই কুড়ি-বিশের দ্বৈরথেও জিতেছিল তাঁর দল। প্রোটিয়াদের কাছে দুই ম্যাচেই আবার নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। দিন দুয়েক আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আবারও টি-টোয়েন্টিতে জয়ের কক্ষপথে ফেরে বটে মাশরাফির দল। কিন্তু মাত্র ১৩১ রান তাড়া করতে গিয়ে যেভাবে বারবার হোঁচট খাচ্ছিল বাংলাদেশ, তাতেই এই ফরম্যাটের অনভ্যস্ততা অপ্রকাশিত থাকেনি। স্পষ্ট হয়ে যায় দুর্বলতাও।
ক্রিকেটীয় বিবেচনায় এই টি-টোয়েন্টি কখনোই খুব উঁচুতে স্থান পায় না মাশরাফির দৃষ্টিতে। বরং অর্ধযুগ ধরে টেস্ট খেলতে না পারার হাপিত্যেশ প্রায়ই করেন অলস আড্ডায়। কিন্তু টি-টোয়েন্টি যে সময়ের দাবি, অস্বীকার করেন না তাও। আর এখন তো এটিই বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সামনে এই ফরম্যাটের এশিয়া কাপ। এরপর বিশ্বকাপ। ওয়ানডের বিশ্বমঞ্চে যেভাবে ক্রিকেটবিশ্বের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ, মার্চে ভারতে অনুষ্ঠেয় টি-টোয়েন্টির বৈশ্বিক আসর ঘিরেও একই লক্ষ্য। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজটি এ কারণে মহাগুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য।
এই সিরিজ শুরুর আগেই মাশরাফি বলেছিলেন, জয়-হারের চেয়ে কম্বিনেশন খুঁজে পাওয়া তাঁর দলের জন্য জরুরি বেশি। সেই কম্বিনেশনে বোলার মাশরাফির পাশাপাশি ব্যাটসম্যান মাশরাফির ভূমিকাও দেখা যাচ্ছে অনেক বেশি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ জয়ের শেষ চিহ্ন আঁকা তাঁর ব্যাটেই। টি-টোয়েন্টির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্যারিয়ার-সায়াহ্নে এসে সেই ক্যারিয়ার-ঊষালগ্নের মিনি অলরাউন্ডারের ছায়া যেন মাশরাফির মধ্যে। যে করেই হোক, ওয়ানডে সাফল্যের প্রতিচ্ছবি যে টি-টোয়েন্টিতেও নিয়ে আসা চাই!
সেটি যদি পারেন মাশরাফি, বাংলাদেশ ক্রিকেটের বাঁকবদলের আরেক অধ্যায়েরও মহানায়ক হয়ে থাকবেন তিনি। আজ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি হতে পারে কাগজের নৌকায় চড়ে আগুননদী পাড়ি দেওয়ার পথে আরেক ঘাটে পৌঁছানো। তাতে কাণ্ডারি যখন মাশরাফি, আশার আকাশটা বড় করতেই পারেন বাংলাদেশের ক্রিকেট-পাগলরা।