ডাকসু নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর মঙ্গলবার (১২ মার্চ) একদিনে চার রকম কথা বললেন নুরুল হক নুরু। একেকবার একেক রকম কথায় বদলে যাচ্ছে তার অবস্থান, সৃষ্টি হচ্ছে নাটকীয় পরিস্থিতি।
মঙ্গলবার দুপুর থেকে সন্ধ্যার মধ্যে একাধিকবার গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তিনি প্রথমে তাদের প্যানেল থেকে জেতা নিজেরটিসহ দুটি পদ বাদে বাকি ২৩টিতে পুনর্নির্বাচন দাবি করেন এবং ঢাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেন। এরপর ছাত্রলীগ সভাপতি ও পরাজিত ভিপি প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কোলাকুলি করে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিলে ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা প্রত্যাহার করে নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে খতিয়ে দেখার আহ্বান জানান নুর। এরপর সন্ধ্যায় বাম জোটগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পর সব পদে ৩১ মার্চের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানান তিনি। এরই একটু পরে আরেকটি গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে নুর নিজে শপথ নেবেন বলে জানান।
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে গতকাল সোমবার (১১ মার্চ) থেকেই উত্তেজনা ও অস্থিরতায় উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অনিয়মের অভিযোগ এনে গতকাল দুপুরেই ছাত্রলীগ ছাড়া বাকি সব প্যানেল ও বেশ কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই বয়কটের সিদ্ধান্ত নেওয়াদের মধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্যানেল সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদও ছিল। তবে গভীর রাতে ডাকসুর ফল ঘোষণা হলে ২৫টি পদের বিপরীতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্যানেল সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ভিপিসহ দুটি পদে জয়লাভ করে। এদিকে ভিপি পদে পরাজিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মীরা এই পদে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে ভিসির বাসার সামনে আন্দোলন শুরু করে। অন্যদিকে, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ছাত্রদল, বামসহ বাকি সংগঠন ও প্যানেলগুলো নির্বাচন বাতিলের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন ও মিছিল করে। এরইমধ্যে দুপুরে হাসপাতাল থেকে ক্যাম্পাসে আসেন ভিপি পদে জয়ী নুর। তিনি সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ প্যানেলের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে ডাকসুতে তাদের জেতা দুটি পদ বাদে বাকি ২৩টি পদে নির্বাচনের দাবি জানান। এর কিছুক্ষণ পর তাকেসহ অন্য নেতাকর্মীদের ধাওয়া দেয় ছাত্রলীগ।
অন্যদিকে, উপাচার্যের বাসভবনের সামনে ভিপি পদে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে বসা ছাত্রলীগ নেতাদের উঠে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভোটের প্রতি সম্মান জানিয়ে নুরকে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান ছাত্রলীগ সভাপতি ও ডাকসুর ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী রেজওয়ানুল হক শোভন। এরপর বিকালে টিএসসিতে গিয়ে নুরকে শুভেচ্ছা জানান ও তার সঙ্গে কোলাকুলি করেন তিনি। এ সময় ছাত্রলীগ সভাপতি সবাইকে একাডেমিক কার্যক্রমে ফেরার আহ্বান জানান। পরে নুর বুধবারে ডাকা ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের সব ধরনের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন।
টিএসসি মিলনায়তনে ছাত্রলীগ সভাপতি শোভন বলেন, ‘আমাদের সবার চাওয়া-পাওয়া নুরুল হক পূরণ করবেন। আমি পারিনি কী হয়েছে, নুরুল হক পূরণ করবে। সে জন্য সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে, যেন স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ঠিক থাকে।’
এর জবাবে নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক বলেন, ‘ছাত্রলীগ আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। আমি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে চাই। আমার ওপর ছাত্রলীগ যে হামলা করেছে, তা বিচারের দায়িত্ব আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রক্টর ও ছাত্রলীগ সভাপতির ওপর দিলাম।’
পরে তিনি বলেন, ‘ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের যে ঘোষণা দিয়েছিলাম, সেটা প্রত্যাহার করে নিলাম।’
এদিকে, এই ঘোষণাকে সাধারণ ছাত্রসহ সব মহল গ্রহণ করে নিলেও টিএসসিতে বাম সংগঠনগুলোর নির্বাচন না মানা ও পুনর্নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি চলতেই থাকে। তাদের সঙ্গে সন্ধ্যায় বৈঠকের পর ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, ‘ছাত্ররা যে রকম আশা করেছিল, সে রকম নির্বাচন হয়নি। ছাত্রলীগ বাদে সবাই গতকাল ভোট বর্জন করেন। কারচুপি করেও আমাদের ঠেকাতে পারেনি। শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে আমি বলতে চাই, যেহেতু আরও অনেক প্যানেল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, আমরা তাদের দাবির সঙ্গে একমত। এ নির্বাচন পুনরায় হতে হবে এবং নির্বাচনে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের পদ ত্যাগ করতে হবে। অন্যদের অধীনে আমরা নির্বাচনে অংশ নেবো। ক্ষমতাসীনরা যখন সুবিধাজনক মনে করে, আমাদের লাগে, তখন বুকে টেনে নেয়। আবার যখন মনে করে আমরা শত্রু, তখন মার দেয়। তার উদাহরণ আমরা গতকালও দেখেছি। রোকেয়া হলে ছাত্রলীগ নেত্রীরা আমাদের মেরেছে। গত ৩০ জুন তারা আমাকে মেরেছিল। আজকেও শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে আমি টিএসসিতে এসেছি, কিন্তু আমাকে তারা ধাওয়া দিয়েছে। তাদের মুখে মধু অন্তরে বিষ। তাদের বিশ্বাস করাটা খুব টাফ। মিথ্যা অভিযোগে মামলা দেওয়া হয়েছে। আমরা খুব অবাক হয়েছি। আমার যদি শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা না থাকতো, তারা আমাকে ভিপি নির্বাচিত করতো না।’
এরপর ডাকসু নির্বাচনের ফল বাতিল করে আদালতের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে ফের সব পদে নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানান নবনির্বাচিত সহ-সভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নুর।
তৃতীয় দফার কথায় সব পদে নির্বাচন চাইতে না চাইতেই একটু পরেই আরেকটি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় নুর ভিপি পদে শপথ নেওয়ার কথাও জানান।
ফলে তার কথা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কৌতূহল, ক্ষোভ, আনন্দ, হতাশাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
উল্লেখ্য, গতকাল সোমবার (১১ মার্চ) দীর্ঘ ২৮ বছর ১০ মাস পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুর পেয়েছেন ১১ হাজার ৬২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন পান ৯ হাজার ১২৯ ভোট।