ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপ। প্রতিটি ক্রিকেটারেরই স্বপ্ন থাকে বিশ্বকাপ মঞ্চে খেলার। প্রতি চার বছর পর পর অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপ। আর টুর্নামেন্টের একাদশে সুযোগ পেতে মুখিয়ে থাকে প্রতিটিদেশের ক্রিকেটাররা। এই মঞ্চে কেউ সফল হয় কেউবা হারিয়ে যায়। আসন্ন বিশ্বকাপ মঞ্চ কারো কারো ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ। চলুন জেনে নেয়া যাক কার কার শেষ বিশ্বাকাপ:
মাশরাফি বিন মতুর্জা (বাংলাদেশ)
দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ সদস্য তিনি। দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশকে বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন মাশরাফি। তার অধীনেই ২০১৫ অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ। তার আগে ইংল্যান্ড, আফগানিস্তান ও স্কটল্যান্ডকে নিয়ে গড়া গ্রুপ ‘এ’ থেকে সেরা হয় টাইগাররা। সেবারই প্রথম বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে যায় বাংলাদেশ। যদিও কোয়ার্টারে ভারতের কাছে হেরে যায়। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্বকাপে দলের সবচেয়ে উত্তেজক ১৫ রানের জয়টাও স্মরণীয়।
বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মাশরাফি, দলকে ৭৩টি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়ে ৪০টিতে জয় পেয়েছেন। ২০৫ ওয়ানডেতে একবার পাঁচ উইকেটসহ ২৫৯টি উইকেট নিয়েছেন মাশরাফী। যা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। এই ফরম্যাটে ওভার প্রতি তার রান দেয়ার গড় পাঁচের কম।
বিশ্বকাপের আগে মাশরাফি জানিয়েছেন, এই আসরই তার শেষ বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপের আগে দেশের মাটিতে শেষ সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফি পরিষ্কার করেই জানান, সম্ভবত নয়, নিশ্চিতভাবেই এটিই শেষ। শেষ বিশ্বকাপ বললেও মাশরাফি বিশ্বকাপেই ইতি বলবেন, নাকি পরে কিছু সময় ওয়ানডে চালিয়ে যাবেন কিনা সেটি নিয়ে কিছু বলেননি।
‘সম্ভবত নয়, নিশ্চিত এটা আমার শেষ বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ ঘিরে আলাদা করে তৈরি করার আসলে কিছু নেই। আলাদা করতে গেলে চাপ থাকবে। আলাদা কিছু করেও মনে হয় না কিছু করতে পারব ইংল্যান্ডে। একজন খেলোয়াড় হিসেবে আগে পারফর্ম করার চেষ্টা করতে হবে। নিঃসন্দেহে অধিনায়কত্ব খুব গুরুত্বপূর্ণ হবে। আমার যে দায়িত্ব আছে, চেষ্টা করবো সেটা পুরোপুরি ঠিক করে রাখার।’ বলেছেন মাশরাফী।
ক্রিস গেইল (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)
সাত মাস পর গত ফেব্রুয়ারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ওয়ানডে দলে ফেরেন ক্রিস গেইল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুর্দান্ত খেলা ওই সিরিজের সময় এ বিগহিটার জানান, বিশ্বকাপই হতে পারে তার শেষ ওয়ানডে টুর্নামেন্ট।
ইংল্যান্ড সিরিজে ফিরেই ক্রিকেটপ্রেমীদের গেইল জানান দেন, কেনো তিনি সামনে চলতে চান। আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ের একনম্বর দল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চার ইনিংসে দুই সেঞ্চুরি ও দুই হাফসেঞ্চুরিসহ করেন ৪২৪ রান। ১৯৭৯ সালের পর আবার বিশ্বকাপ ট্রফি উচিয়ে ধরতে এবং তার বিদায় বেলায় ইংল্যান্ডের মাটিতে গেইলের এই রূপটা দেখতে চাইছে ক্যারিবীয়রা।
জেপি ডুমিনি (সাউথ আফ্রিকা)
সাউথ আফ্রিকার টি-টুয়েন্টি দলের নিয়মিত মুখ হলেও ওয়ানডেতে খুব একটা দেখা যায় না জেপি ডুমিনিকে। বিশ্বকাপের পর ওয়ানডে দলেই হয়তো আর পাওয়া যাবে না তাকে।
ইনজুরির কারণে বেশ কয়েকমাস সাইডলাইনে কাটানোর পর গত মার্চে দলে ফেরেন ডুমিনি। তখন ৫০ ওভারের গেম থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার কথা জানান। তার একদিন পর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কেপটাউনে খেলা ওয়ানডে ম্যাচকে দেশের মাটিতে শেষ ম্যাচ বলে জানিয়ে দেন।
২০০৪ সালে কলম্বোতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেক হয় ডুমিনির। কিন্তু ক্যারিয়ারের অধিকাংশটা তার কেটেছে ইনজুরিতে। তা স্বত্বেও দেশের হয়ে শীর্ষ দশ রান স্কোরারের একজন তিনি। ৫০৪৭ রান করা ডুমিনি আর ছয়টা ম্যাচ খেললেই সাউথ আফ্রিকার হয়ে ২০০ ওয়ানডে খেলা সপ্তম ক্রিকেটার হয়ে যাবেন।
ইমরান তাহির (সাউথ আফ্রিকা)
উইকেট পেলেই পাখির ডানা মেলার ঢঙে দু’হাত মেলে আগ্রাসী উদযাপন। রান দেয়ায় কিপ্টেমি ও বিশেষ ধরনের উদযাপনের স্টাইলের জন্য ক্রিকেটভক্তদের হৃদয়ে আলাদা একটা জায়গা করে নিয়েছেন। এবার ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পালা। যার প্রথম ধাপ হিসেবে দেশের জার্সি তুলে রাখতে চলেছেন সাউথ আফ্রিকার ৩৯ বছরের তারকা স্পিনার তাহির।
ইংল্যান্ডের মাটিতে দেশের হয়ে শেষবারের জন্য বিশ্বকাপ মঞ্চে নিজের সেরাটা দিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে বিদায় নিতে চান ইমরান। বিশ্বকাপ খেলেই ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে অবসরের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে এ যুগের অন্যতম সেরা লেগস্পিনার। বিশ্বকাপ পরবর্তী সময়ে দেশের হয়ে শুধু মাত্র টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে খেলবেন তিনি।
চলতি মাসেই ৪০ বছরে পা দিচ্ছেন প্রোটিয়া এ লেগস্পিনার। সাউথ আফ্রিকার হয়ে ২০ টেস্টের পাশাপাশি ৯৫টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন তাহির। ৯৫ ওয়ানডেতে উইকেটের সংখ্যা ১৫৬টি। ৩৭টি টি-টুয়েন্টি ম্যাচে পেয়েছেন ৬২ উইকেট।
শোয়েব মালিক (পাকিস্তান)
ব্যাট-প্যাড তুলে রাখার সময়টা আগেই জানিয়ে দিয়েছেন পাকিস্তানের অলরাউন্ডার শোয়েব মালিক। ২০২০ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের পরই ক্রিকেটকে বিদায় বলবেন তিনি। সেজন্য অবশ্য ফর্মের ধারাবাহিকতাটা ধরে রাখতে চান মালিক।
পাঁচ বছরের দীর্ঘ বিরতি দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে ফিরেছিলেন। পরে মাত্র তিনটি টেস্ট খেলেই ২০১৫তে সাদা পোশাক থেকে অবসর নেন পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক। তবে লংগার ভার্সন থেকে ছুটি নিলেও ওয়ানডে ও টি-টুয়েন্টি খেলে যাচ্ছেন।
তবে টি-টুয়েন্টি থেকে ২০২০-এ অবসর নিলেও তিনি বলেছেন, ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপই হবে তার শেষ বিশ্বকাপ। সময়টা ঠিক করলেও মালিক জানিয়েছেন সবকিছু নির্ভর করছে পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতার উপর, ‘দুটি বিশ্বকাপই আমার বড় টার্গেট, যেদিকে তাকিয়ে আছি। দেখা যাক কী ঘটে। যদি ফর্মের ধারাবাহিকতা থাকে, তাহলে দুটি বিশ্বকাপই খেলব।’
স্বাভাবিকভাবে একজন ব্যাটসম্যান, সেই সঙ্গে কার্যকর অফস্পিনার, মেধাবী ফিল্ডার এবং একজন সফল অধিনায়ক- শোয়েব মালিক দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তানের সবচেয়ে গতিশীল, নির্ভরযোগ্য ও সম্পূর্ণ ক্রিকেটারদের একজন। পাকিস্তানের জার্সিতে ২৮২টি ওয়ানডে খেলেছেন মালিক।
একদিনের ম্যাচে এখন পর্যন্ত ৭৪৮১ রান করেছেন, যা পাকিস্তানের পঞ্চম সর্বোচ্চ। ১৫৬টি উইকেটের সঙ্গে ৯৬টি ক্যাচ নিয়েছে ওয়ানডে ম্যাচে। ১৯৯৯তে অভিষেকের দুই দশক পর এবার শেষ করতে চাইছেন মালিক।
ডেল স্টেইন (সাউথ আফ্রিকা)
গত কয়েক বছর ধরে চোটের পর চোট। রীতিমতো বিরক্ত তিনি। চোটের সঙ্গে আর লড়াই করবেন না! হতাশা এতটাই যে, সাউথ আফ্রিকার স্পিডস্টার ডেল স্টেইন অবসরের চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দিয়েছেন।
এবি ডি’ভিলিয়ার্সের পর সাউথ আফ্রিকা ক্রিকেটের আরো এক নক্ষত্র পতনের পথে। ২০১৯ বিশ্বকাপের পর আরো শূন্য হতে চলেছে সে দেশের ক্রিকেট। স্টেইন বলছেন, ‘২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত নিজেকে ফিট রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিন্তু তারপর আপনারা হয়তো আমাকে আর একদিনের ক্রিকেটে দেখতে পাবেন না। তাছাড়া এর পরের বিশ্বকাপে আমার বয়স ৪০ হবে।’
দেশের জার্সিতে ১২৫টি ওয়ানডে ম্যাচে এখন পর্যন্ত ১৯৬টি উইকেট নিয়েছেন স্টেইন। সবচেয়ে বড় কথা ওয়ানডে ম্যাচে তার ওভার প্রতি রান দেয়ার গড় পাঁচের কম এবং তিন উইকেট নিয়েছেন তিনবার। চোট তাকে যতই ভোগাক না কেনো, তবুও তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুততম এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বোলারদের মধ্যে রয়েছেন।
যাদের নিয়ে আলোচনা হল তারা সবাই বিশ্বকাপের পর ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা অথবা ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন। তবে এর বাইরেও অনেকে আছেন, যারা ঘোষণা দেননি কিন্তু বয়স আর পারিপার্শিক কারণে বিশ্বকাপের পর একদিনের ক্রিকেট থেকে বিদায় নিতে পারেন। এই তালিকায় আলোচিতদের মধ্যে আছেন ভারতের সাবেক অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি, সাউথ আফ্রিকা ওপেনার হাশিম আমলা, পাকিস্তানি অলরাউন্ডার মোহাম্মদ হাফিজ এবং শ্রীলঙ্কান পেসার লাসিথ মালিঙ্গা।