নকশা জটিলতায় গতি হারিয়েছে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ। তার সঙ্গে গতিহারা হয়ে পড়েছে মগবাজার-মৌচাকের ব্যস্ততম রাস্তাগুলোও। নির্মাণ সামগ্রী রেখে রাস্তা দখল করার কারণে চরম যানজটে প্রতিদিন-প্রতিমুহূর্তে নাকাল হতে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে। কবে নাগাদ এর নির্মাণ কাজে গতি ফিরবে বলতে পারছে না কেউ।
২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর চরম ধীর গতিতে চলতে থাকে ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মধ্যে এই ফ্লাইওভারের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এই সময়ের মধ্যে আদৌ নির্মাণকাজ শেষ হবে কি না এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন ভূক্তভোগীরা। গত ২ বছর ২ মাসে এ প্রকল্পের অধীনে কয়েকটি পিলার পাইলিংয়ের কাজ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো কাজই হয়নি।
কাজ হওয়া না হওয়া নিয়ে জনসাধারণের তেমন একটা মাথাব্যাথা না থাকলেও দুর্বিসহ দুর্ভোগের কারণে নির্মিয়মান মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারটি এখন রাজধানীবাসীর প্রধানতম আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ দীর্ঘ এ রাস্তায় যত্রতত্র নির্মাণ সামগ্রী ফেলে রাখা এবং রাস্তা খুঁড়ে খানাখন্দ তৈরি করার কারণে সরু ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে চলাচলের পথ। ফলে রাত-দিন এখানে লেগে থাকে দুঃসহ যানজট।
বিশেষ করে ইস্কাটন, সাতরাস্তা, হাতির ঝিল, মৌচাকসহ অধিকাংশ এলাকায় নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকলেও যত্রতত্র নির্মাণসামগ্রী রেখে দখল করে রাখা হয়েছে যান চলাচলের পথ। এতে এসব এলাকায় যানজট আরো অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। খানা-খন্দে ভরা রাস্তায় যানবাহন চলাচল করছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। এর জের ধরে শহরের বিশাল অংশজুড়ে সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ যানজট। প্রতিদিন খোয়া যাচ্ছে কর্মজীবী মানুষের কর্মঘণ্টা।
আগে মালিবাগ থেকে ৬নং বাসে ফার্মগেট যেতে সময় লাগতো ১৫ থেকে ২০ মিনিট। সেখানে যানজটের কারণে এখন সময় লাগছে এক থেকে দেড় ঘণ্টা। ১০ মিনিটে যেখানে তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে পায়ে হেঁটে মগবাজার মোড়ে আসা যায় সেখানে বাসে সময় লাগছে ১ ঘণ্টার মতো- এমন অভিযোগই করলেন ৬নং বাসের চালক মো. মিজান।
মগবাজার মোড় থেকে মালিবাগ মোড়ের চিত্রও একই। এ পথে ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত যানজট লেগে থাকে। সামান্য বৃষ্টি হলেই সৃষ্টি হয় জলজট। তখন আর ভোগান্তির অন্ত থাকে না। আবার যখন রোদ হয় তখন তীব্র ধুলোয় আচ্ছন্ন হয়ে যায় পুরো এলাকা। এ ফলে রাস্তায় চলাচলও ভীষণ দায় হয়ে পড়ে।
এদিকে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণ এলাকার এমন অবস্থা দেখে ভীষণ ক্ষেপে গেছেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এ এলাকার সড়কগুলো সংস্কার করে জনদুর্ভোগ সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে সময় বেঁধে দিয়েছেন তিনি। গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক জরুরি বৈঠকে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন মন্ত্রী।
কর্মকর্তাদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, ‘১৫ দিনের সময় বেঁধে দিলাম। ঠিক ১৫ দিন পর আমি সেখানে যাবো। এরমধ্যে দুর্ভোগ সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো প্রকার ছাড় দেয়া হবে না।’
সরেজমিনে ফ্লাইওভার নির্মাণ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রৌদ্রের দিনে মগবাজার, ইস্কাটন, সাতরাস্তা ও মৌচাক এলাকায় যেমন যানজট তেমনি ধূলায় ভরা। পুরো এলাকা প্রায় বাস অযোগ্য হয়ে পড়েছে। জানা গেছে, রাস্তায় পানি ছিটিয়ে ধুলা দূর করার কথা থাকলেও সেটা করছে না সংশ্লিষ্টরা। ফলে চরম অস্বস্তিকর ও স্বাস্থহানীকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এ এলাকায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্প এলাকা ও আশপাশের ভূগর্ভস্থ বিভিন্ন পরিসেবা বিশেষ করে বিদ্যুৎ, গ্যাস, ওয়াসা ও ড্রেনেজ সংযোগ লাইনের কারণে ফ্লাইওভারের পাইলিংয়ের কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া প্রকল্প এলাকার সড়ক খুব ব্যস্ত ও অপ্রশস্ত হওয়ায় সংযোগ লাইনগুলো অপসারণ করাটাও বেশ জটিল কাজ। ফলে বাধ্য হয়ে নকশা পরিবর্তন করেই ঠিকাদারদের কাজ করতে হচ্ছে।
এজন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে। নকশার পাশাপাশি প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয়েও পরিবর্তন আসতে পারে বলে জানিয়েছে সূত্র।
সূত্র জানায়, তিন ভাগে নির্মিততব্য এই ফ্লাইওভারটির প্রথম পর্যায়ে তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে শুরু করে এফডিসি রেলক্রসিং পার হয়ে মগবাজার চৌরাস্তা হয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের কাছে নেমে যাবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে বাংলামোটর থেকে মগবাজার-মৌচাক-মালিবাগ হয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে গিয়ে শেষ হবে। আরেকটি ধাপে রামপুরা রোড থেকে মৌচাক হয়ে শান্তিনগর গিয়ে শেষ হবে। মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)।
এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী নাজমুল হোসেন বলেন, ‘বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে ভূগর্ভস্থ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সংযোগ লাইন অপসারণ না করেই ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করা হচ্ছে। ফ্লাইওভারের নকশায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হচ্ছে। মূল অবকাঠামো ঠিক রেখেই নির্মাণ কাজ করা হচ্ছে। এজন্য বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেয়া হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, ৮ দশমিক ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ ফ্লাইওভারের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন রয়েছে ২০০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
এছাড়া সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) থেকে ৩৭৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা ও ওপেন ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ওএফআইডি) থেকে ১৯৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ঋণ হিসেবে পাওয়া যাবে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, তিন লেনবিশিষ্ট এ ফ্লাইওভারে ওঠানামার জন্য ৮টি পথ থাকবে। এতে ফ্লাইওভার থেকে তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা, এফডিসি, মগবাজার, হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল, বাংলামোটর, মগবাজার, মালিবাগ, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং শান্তিনগর মোড়ে ওঠানামা করা যাবে।
প্রকল্পটির দুটি প্যাকেজের জন্য ২০১২ সালের নভেম্বরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে এলজিইডি। ডব্লিউ-৪ প্যাকেজের ২ দশমিক ১ কিলোমিটারের ঠিকাদার হিসেবে কাজ পেয়েছে ভারতের সিমপ্লেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও দেশীয় নাভানা কন্সট্রাকশনের যৌথ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠান সিমপ্লেক্স-নাভানা জেভি।
ডব্লিউ-৬ প্যাকেজের ২ দশমিক ২ কিলোমিটার অংশের ঠিকাদার চীনের মেটালারজিক্যাল কনস্ট্রকাশন ওভারসিজ কোম্পানি (এমসিসিসি) ও দেশীয় তমা কনস্ট্রাকশন।
বাংলামেইল২৪ডটকম/ আরবি/ আরএম