হাওর-বাওর ও সমতলভূমির বৈচিত্র্যময় ভূ-প্রকৃতির একটি বিস্তীর্ণ জনপদ কিশোরগঞ্জ জেলা। এর মাটির পরতে পরতে লুকিয়ে আছে লোকসংস্কৃতি। গ্রামবাংলার শাশ্বত রূপ বৈচিত্র্য ও সোনালি ঐতিহ্যের ধারায় কিশোরগঞ্জের রয়েছে একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস। প্রশাসনিক পরিসরে এটি দেশের অন্যতম বৃহত্তম জেলা। কিন্তু ‘কিশোরগঞ্জ’ নামকরণ কিভাবে হলো তা আমাদের অনেকেরই অজানা। এ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠের বিশেষ প্রতিবেদন কিশোরগঞ্জের নামকরণের ইতিহাস।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তেও ‘কাটখালী’ নামে পরিচিত ছিল কিশোরগঞ্জ। ইতিহাসবিদদের ধারণা ও জনশ্রুতি অনুযায়ী, ষষ্ঠ শতকে বত্রিশ এর বাসিন্দা কৃষ্ণদাস প্রামাণিকের ছেলে নন্দকিশোর ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে একটি গঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেন; এ গঞ্জ থেকেই কালক্রমে নন্দকিশোরের গঞ্জ বা ‘কিশোরগঞ্জ’-এর উৎপত্তি হয়। একাদশ ও দ্বাদশ শতকে পাল, বর্মণ ও সেন শাসকরা এ অঞ্চলে রাজত্ব করে। তাদের পর ছোট ছোট স্বাধীন গোত্র কোচ, হাজং, গারো এবং রাজবংশীরা এখানে বসবাস করে। ১৪৯১ সালে ময়মনসিংহের অধিকাংশ অঞ্চল ফিরোজ শাহ-এর অধীনে থাকলেও কিশোরগঞ্জ সেই মুসলিম শাসনের বাইরে রয়ে যায়। পরবর্তীতে মুঘল সম্রাট আকবরের সময়কালে বেশিরভাগ অঞ্চল মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে থাকলেও জঙ্গলবাড়ি ও এগারসিন্দুর কোচ ও অহম শাসকদের অধীনে রয়ে যায়। ১৫৩৮ সালে এগারসিন্দুরের অহম শাসক মুঘলদের কাছে ও ১৫৮০ সালে জঙ্গলবাড়ির কোচ শাসক ঈসা খাঁর কাছে পরাজিত হয়। ১৫৮০ সালে বার ভূঁইয়াদের প্রধান ঈসা খাঁ এগারসিন্দুরে আকবরের সেনাপতি মান সিংহকে পরাজিত করেন। ঈসা খাঁর মৃত্যুর পর জঙ্গলবাড়ি ও এগারসিন্দুর তার পুত্র মুসা খাঁর অধীনে আসে কিন্তু ১৫৯৯ সালে তিনি মুঘলদের কাছে পরাজিত হন।
১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জকে জেলা ঘোষণা করা হয়। কিশোরগঞ্জের ভৌগোলিক আয়তন প্রায় ২,৬৮৮ বর্গ কিলোমিটার। এই আয়তনে ১৩টি উপজেলা রয়েছে। যথাক্রমে কিশোরগঞ্জ সদর, অষ্টগ্রাম, ইটনা, করিমগঞ্জ, কটিয়াদি, কুলিয়ারচর , তাড়াইল, নিকলী, পাকুন্দিয়া, বাজিতপুর, ভৈরব, মিটামইন ও হোসেনপুর উপজেলা। এই জেলার উত্তরে নেত্রকোণা জেলা ও ময়মনসিংহ জেলা, দক্ষিণে নরসিংদী জেলা ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলা, পূর্বে সুনামগঞ্জ জেলা ও হবিগঞ্জ জেলা, পশ্চিমে ময়মনসিংহ জেলা ও গাজীপুর জেলা।
কিশোরগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক পুরাকীর্তিগুলো হলো ঈশা খাঁর দ্বিতীয় রাজধানী জঙ্গলবাড়ি, ঈশা-খাঁর এগারসিন্ধুর দুর্গ, বঙ্গের আদি মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত শিবমন্দির, মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে প্রতিষ্ঠিত দিল্লির আখড়া, প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পৈত্রিক ভূমি।
দর্শনীয় স্থানের মধ্যে আরও আছে নরসুন্দা লেক সিটি, পাগলা মসজিদ, শহিদী মসজিদ, কুতুব মসজিদ, ঈশা খাঁ মসজিদ, গাংগাটিয়া মানব বাবুর জমিদার বাড়ি। এছাড়া রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ ঈদের জামাত অনুষ্ঠেয় ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান।
কিশোরগঞ্জের যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা : রাজধানী ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জের দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার। সড়ক পথে কিশোরগঞ্জ পৌঁছাতে বাসযোগে ভাড়া ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা। বাস যোগাযোগ ছাড়াও কিশোরগঞ্জের সাথে ঢাকার ট্রেন যোগাযোগও অত্যন্ত জনপ্রিয়। ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে প্রতিদিন এগারসিন্দুর ও কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস নামে দুইটি আন্ত:নগর ট্রেন নিয়মিত চলাচল করে।