কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা বসতি ক্যাম্পের বেশিরভাগ ঘরই এখন ইয়াবার গুদাম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বলে জানা গেছে। মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের নাফ নদী পার করেই ইয়াবার চালানগুলো এনে সংরক্ষণ করা হচ্ছে রোহিঙ্গা বসতির ওইসব ঘরে। পাহাড়ের এই ঘন বসতিপূর্ণ ঘরগুলোতে ইয়াবা মজুতের তথ্য ও অভিযোগ থাকলেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সাঁড়াশি অভিযান চালাতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অপরদিকে সেই সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে মাদক কারবারি রোহিঙ্গারা। ইয়াবার কারবার করেই রোহিঙ্গাদের অনেকে এখন কোটিপতি। নামমাত্র তারা ক্যাম্পে বসবাস করলেও বাইরে থেকে নানা কৌশলে আধুনিক জীবনযাপন করছে।
গত সপ্তাহজুড়ে সরেজমিন কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকা ঘুরে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। এ সময় কক্সবাজারে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা সময়ের আলোকে বলেন, টেকনাফ ও উখিয়ায় ইয়াবা কারবারের শতকরা ৮০ ভাগই নিয়ন্ত্রণ করছে বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গা নাগরিকরা। টেকনাফে এদের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। কারণ টেকনাফের ক্যাম্পের বসতিগুলো বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নাফ নদী সংলগ্ন পাহাড়ে। এর ফলে সীমান্ত দিয়ে কোনো মতে নাফ নদী পার করে একবার ক্যাম্পে ঢুকে গেলে তারা সম্পূর্ণ নিরাপদভাবে ইয়াবা সংরক্ষণ করতে পারছে। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়েও ২০ শতাংশ লোক বর্তমানে ইয়াবা তথা মাদক কারবারে সক্রিয় রয়েছে। তবে দেড় বছর আগেও এ পরিমাণ ছিল অনেক বেশি।
কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, টেকনাফে আগের মতো অবাধ ইয়াবা ব্যবসা আর নেই। টেকনাফ ও উখিয়াসহ কক্সবাজারে গত দেড় বছর ধরে মাদক নির্মূলে কঠোর অভিযানের ফলে স্থানীয়দের অনেকেই ভয়ে ইয়াবা ব্যবসা থেকে এই মুহূর্তে দূরে আছে। বিভিন্ন পর্যায়ের ৩৩ মাদক ব্যবসায়ী ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছে। ১০২ জন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করেছে। বর্তমানেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এর ফলে স্থানীয়দের মধ্যে ইয়াবা কারবারের প্রবণতা কমেছে। তবে এখন মূলত ইয়াবা কারবার ব্যাপক হারে চালিয়ে যাচ্ছে এক শ্রেণির রোহিঙ্গা নাগরিক। তারা তাদের ঘরগুলোতে ইয়াবা সংরক্ষণ করছেন বলেও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। নিয়মিত অভিযানও চলছে।
টেকনাফ সদর, জাদী মোরা, শালবন ও উখিয়ার বিভিন্ন এলাকায় তথ্য অনুসন্ধানকালে জানা যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অভিযানের মুখে টেকনাফের স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের তৎপরতা কিছুটা কমে গেছে। তবে সুযোগ পেলে তারা আবারও মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠবে। তবে বর্তমানে রোহিঙ্গা পুরুষরা মিয়ানমার থেকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা এনে ক্যাম্পের ঘরে ঘরে মজুত করছে। এরপর রোহিঙ্গা পুরুষরা অন্তরালে চলে যাচ্ছে। সামনে আসছে এই চক্রের রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা। তারা অনেকেই একই পরিবারের। ইয়াবা ব্যবসা তাদের কাছে যেন হালাল উপার্জন। এই রোহিঙ্গা নারীরা স্থানীয় নারীদের সঙ্গে এক ধরনের নেটওয়ার্ক তৈরি করে হাত বদলের মাধ্যমে ইয়াবা পৌঁছে দিচ্ছে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে। আরও জানা গেছে, ইয়াবা পাচারের মাধ্যম হিসেবে এসব এলাকায় পাহাড়ি ও বনজঙ্গলের পথ ব্যবহার করা হচ্ছে। যেসব এলাকায় চেকপোস্ট আছে ওই সব এলাকায় তারা বিকল্প পথ তৈরি করে যাতায়াত করছে। এ ছাড়া ইজিবাইক (টমটম) ও অটোরিকশায় করে ইয়াবার চালান আনা নেওয়া করা হচ্ছে। এর আগেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিপুল ইয়াবা উদ্ধার করে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, কক্সবাজারের স্থানীয় পর্যায়ে বা বাইরে বিভিন্ন এলাকায় মাদকবিরোধী কঠোর অভিযান চললেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে বসতঘরগুলোতে সেভাবে সাঁড়াশি অভিযান চালাতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর কারণ হিসেবে কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় হাজার হাজার বসতিঘর, সেখানে লাখ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। রয়েছে পাহাড়ে আত্মগোপনের ব্যাপক সুযোগ। তাদের হাতে আছে বিপুল দেশি-বিদেশি অস্ত্র। ফলে সবকিছু বিবেচনা করে স্বল্প জনবল নিয়ে কোনো অভিযান চালিয় সেখানে খুব সফল হওয়া যাবে না। বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উল্টো বিপদের সম্মুখীন হতে পারে। এ কারণে সুনির্দৃষ্ট তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে কিছু কিছু এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
সরেজমিন গত এক সপ্তাহ কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থানকালে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের কয়েকটি পয়েন্টের চেকপোস্ট দেখা যায়। একইভাবে কক্সবাজার-উখিয়া-টেকনাফ সড়কেও কয়েকটি চেকপোস্ট দেখা যায়। মূল বিষয় হচ্ছে ওই এলাকায় অবস্থানকালে চেকপোস্টগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইজিবাইক ও অটোরিকশা দাঁড় করিয়ে কেবল যাত্রীদের কাছে আইডি কার্ড আছে কিনা তা জানতে চাওয়া হয়। গাড়ি তল্লাশি বা শরীর, ব্যাগ কোনো কিছুই তল্লাশি করতে দেখা যায়নি।
স্থানীয় কয়েকজন পেশাজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইয়াবার মূল কারবার এখন পরিচালনা করছে রোহিঙ্গারা। এক শ্রেণির রোহিঙ্গারা নাফ নদী পেরিয়ে রাখাইনে এখনও অবাধ যাতায়াত করছে। ওপারে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে ইয়াবা প্রবেশের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের সরাসরি সহায়তা করছে। এদিকে বাংলাদেশে ক্যাম্পের ভেতরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্যার তুলনায় মোতায়েনকৃত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের সংখ্যা অতি সামান্য। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার ঘর। ঢালাওভাবে তল্লাশি চালানোও প্রায় অসম্ভব।
টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, এক সময় কক্সবাজারের সবচেয়ে বেশি ইয়াবার কারবার ছিল টেকনাফে। কিন্তু পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অভিযানের ফলে স্থানীয় পর্যায়ের মাদক ব্যবসা অনেকটাই কমে গেছে। তবে রোহিঙ্গারা ইয়াবা কারবারে ব্যাপক তৎপরতা বাড়িয়েছে। সে অনুসারে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধিসহ অভিযান চলছে।