বই পড়া ও বই লেখা-দুটিই পরম আনন্দের এবং গর্বের। বই পড়ে জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞান আদান প্রদানের সহায়ক ভূমিকা পালন করে। লেখকরা আমাদের চিত্তে সুবাস বইয়ে দেয়? আমরা কি পড়ছি, কী-ই বা পড়া উচিত, বাংলাভাষার সমৃদ্ধি কতটুকু তা বই পড়ার মাধ্যমেই জানা সম্ভব। একজন সৃজনশীল লেখকের কাছে বই যেন তার প্রাণ। জীবন সায়াহ্নে এসেও তার মাথার শিয়রে রয়েছে নানান রকমের বই। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শারিরিকভাবে অসুস্থ হলেও যখনই মনে পড়ে তখনই বই নিয়ে পড়তে বসেন। এ রকম একজন হলেন কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ভুইয়া। যিনি একজন বাম রাজনীতিবীদও। রাজনীতির পাশাপাশি বই পড়া ও লেখা নিয়েই কেটেছে তাঁর জীবনটা। ২০১২ সালে প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়ে তিনি অসহায় হয়ে পড়েন। ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক মানবতা বিরোধী অপরাধ ট্রাইবুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িত করিমগঞ্জের কয়েক রাজাকারের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে স্বাক্ষী দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
এ প্রতিবেদকের কাছে ফেলে আসা অতীত নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন মোহাম্মদ আবদুর রশীদ ভুইয়া। ১৯৫৯ সালের ৩১ আগষ্ট করিমগঞ্জ উপজেলার গোজাদিয়া ইউনিয়নের বৈরাটিয়াপাড়া গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম সুরুজ আলী ভুইয়া ও মাতার নাম মরহুমা ফাতেমা বেগম। প্রাথমিক পড়াশোনা রামনগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে মাধ্যমিকে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি বাম রাজনীতির সাথে জড়িয়ে যান। রাজনীতির পাশাপাশি প্রবন্ধ ও ফিচার লিখেও প্রশংসিত হয়েছেন। তার অনেক প্রবন্ধ ও ফিচার সাপ্তাহিক বিচিত্রা, সাপ্তাহিক একতা, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক জাহান, দৈনিক আজকের সারাদিন, সাপ্তাহিক মেঘনা, সাপ্তাহিক সন্ধানী, অর্থনীতি, প্রজন্ম,চিকিৎসা সাময়িকী, দৃশ্যপট, ধমনিসহ আরও অনেক পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাক হানাদার দখলদার বাহিনী ও এ দেশীয় দোসরদের কবল থেকে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করতে তাঁর কয়েকজন সহপাঠীসহ ভারতে গেলেও বয়স না হওয়ায় সামরিক প্রশিক্ষণে অংশ নিতে পারেননি। সহপাঠীদের প্রশিক্ষণশেষে তিনি তাঁদের সাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ শুরু করেন। ১৯৭১ সালে করিমগঞ্জে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িত ও পরেশ হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী হিসেবে আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইবুনালে করিমগঞ্জের কয়েক রাজাকারের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে স্বাক্ষ্য দেন।
তিনি একজন সৎ নিষ্টাবান রাজনীতিবিদ হিসেবেও খ্যাত ও পরিচিত। রাজনীতি করার কারণে কয়েকবার কারাবরণ করেন। তিনি ১৯৮২ হতে ১৯৯১ পর্যন্ত করিমগঞ্জ উপজেলার কমিউনিষ্ট পার্টির সম্পাদক এবং ১৯৮৩-৯০ পর্যন্ত ক্ষেত মজুর সমিতি করিমগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি এবং জেলা ক্ষেত মজুর সমিতির দুই বারের সাধারণ সম্পাদক, দুই বার সহ-সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ সালে বিশিষ্ট জননেতা জমিয়ত আলীর জীবনীলেখ্য নির্ভর ‘চেনা চোখে জমিয়ত আলী’-শীর্ষক একটি ছোট্ কাগজ সম্পাদনা করেন। করিমগঞ্জের বিশিষ্ট পুঁথিকার মুন্সি আজিমুদ্দিনের হারিয়ে যাওয়া পুঁথি সাহিত্য নিয়ে ‘মুনশি আজিমুদ্দিন নামা’(২০০৫) নামক একটি গবেষণামুলক বই প্রকাশ করেন।
তিনি প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি সাংবাদিকতা পেশার সাথেও জড়িত ছিলেন। ময়মনসিংহ হতে প্রকাশিত দৈনিক আজকের বাংলাদেশ পত্রিকার কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। কিশোরগঞ্জ থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজকের সারাদিন পত্রিকায় গুরুত্বপুর্ণ পদে কাজ করেছেন। প্রতিদিন তিনি উপ-সম্পাদকীয় বিভাগে নিয়মিত লিখতেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়েও মন্তব্য প্রতিবেদন লিখে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তিনি মানুষের দুঃখ দুর্দষা বিশেষ করে যখন লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিলো তখন সেসব স্থানে গিয়ে মানুষের জীবনের দুঃখগাঁথা পত্রিকায় তুলে ধরেছেন।
তিনি করিমগঞ্জ পাঠাগারের সহসভাপতি ও করিমগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমীর সহসভাপতিসহ বিভিন্ন সাহিত্য সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি টামনী আকন্দপাড়ার আঃ কাদিরের মেয়ে তাহমিনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর দু ছেলের মধ্যে বড় ছেলে শাহরিয়ার রশিদ অন্তর কিশোরগঞ্জ কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছোট ছেলে ইমতিয়ার রশিদ প্রান্ত গুরুদয়াল সরকারী কলেজে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে অধ্যয়নরত ।
করিমগঞ্জের বিশিষ্ট ছড়াকার সালেহ আহমেদ বলেন, ৮০ দশকে করিমগঞ্জের শহীদ মিনার নির্মাণকালে রং পরিবর্তনের আন্দোলনে তিনিই ছিলেন পুরোধা। শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠাকালে তিনি আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া তিনি করিমগঞ্জের বাজারে ইজারাদারদের দৌড়াত্বের প্রতিরোধে তাঁর ভূমিকা রয়েছে। তিনি সামাজিক দেন দরবারেও সুন্দর ফয়সালা দিতেন।
শিমুলতলা মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক হারুন অর রশিদ বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অনন্য অবদান রয়েছে। আমি যখন প্রধান শিক্ষক ছিলাম তখন তিনি ছিলেন গোজাদিয়া ইউনিয়নের স্বনামধন্য চেয়ারম্যন। তিনি তাঁর দায়িত্বকে সঠিকভাবে মুল্যায়ন করে দাীর্ঘদিন সুনামের সাথে ইউনিয়নবাসীর সেবা করেছেন।
কিশোরগঞ্জ যুদ্ধপরাধ প্রতিরোধ আন্দোলন কমিটির সভাপতি ও যোদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে মামলার উদ্যেক্তা মোঃ রেজাউল হাবীব রেজা বলেন, করিমগঞ্জের গোজাদিয়ার রামনগরের পরেশ হত্যাকান্ডের বিষয়ে তিনি একজন স্বাক্ষী। ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক মানবতা বিরোধী অপরাধ ট্্রাইবুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে এতদ্বিষয়ে তিনি স্বাক্ষী দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি খুব অসুস্থ তাঁর জন্য আরোগ্য কামনায় সবার কাছে দোয়া প্রার্থী।