মো: স্বপন হোসেন, পাকুন্দিয়া (কিশোরগঞ্জ) থেকে ।। কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী মঙ্গলবাড়ীয়া লিচু। দেশের অন্যতম ও সুনাম ধন্য লিচুর নাম মঙ্গলবাড়ীয়ার লিচু। লিচু তো অনেক আছে দেশে তবে এখানকার লিচুর মত তো নয়। যার স্বাদ ও রুচির তুলনা করা যায় না। যে খেয়েছে কেবল শুধু সেই এই লিচুর স্বাদ গ্রহণ করেছে। এই লিচু খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি তার গঠনপ্রণালীও।
তাই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, ঢাকা ও সিলেটের ব্যক্তিবর্গ সহ স্থানীয় লোকদের ভীড় লেগেই থাকে সারাক্ষণ। অনেক দর্শনার্থী দূর দূরান্ত থেকে এই লিচু দেখতে আসে এবং ক্রয় করে নিয়ে যায়। অনেকেই আসে সেলফি তুলার জন্যও। এতো সুন্দর ও সুস্বাদু লিচু যেন দেখতেই ইচ্ছে করে সারাক্ষণ আর খেতেও। এই বছরে লিচুর বাম্পার ফলন হওয়ায় চাষীদের মুখেও রয়েছে হাসি। অল্প খরচেই অনেক টাকা লাভবান হচ্ছে তারা। শুধু একটু দেখা-শুনার খেয়াল রাখতে হয় তাদের। তবে উপযুক্ত দান নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে লিচু মালিকেরা।
গাছে মুকুল ধরার আগেই কীটনাশক ওষুধ স্প্রে করতে হয় তাদের। মুকুল গজানোর পূর্বে ও পরে কিছু দিন পর পর ধারাবাহিক ভাবে তিন মাসে সাত বার ড্রেসিস ও শিখো এবং পানপিস ও ড্রেসিস স্প্রে করে থাকেন। তাই কীটনাশক থেকে রক্ষা পাওয়ায় বাম্পার ফলনের উৎপাদক সম্ভব হয়ে উঠে। দিনে ও রাতে পরিশ্রম করে এই বাম্পার ফলন ও সুস্বাদু লিচু ফলাতে হয় তাদের। প্রতি রাত ও দিনের জন্য একজন প্রহরী বাবদ চারশত টাকা গুনতে হয় লিচু চাষীদের। কোন চাষীর ত্রিশজন, কোন চাষীর বিশজন বা দশজন করে প্রহরী রাখতে হচ্ছে নিরাপত্তার জন্য। তবুও এই তিন মাসের ফলনে অধিক অঙ্কের টাকা লাভবান হতে পারচ্ছে চাষীরা। শুধু কৃষকগোষ্ঠীই নয় বরং স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাও এই ব্যবসায় মনোনিবেশ হয়েছে এবং অল্প খরচেই অধিক টাকা উপার্জন করছে তাদের শ্রমের মাধ্যমে।
তাদের মত ঐ গ্রামের তওহিদ ব্যাপারী (৬৫)। তিনি পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ড মঙ্গলবাড়ীয়া মুন্সি বাড়ির বাসিন্দা। তিনি ৬টা বাগে মোট ৬০টি গাছে লিচু চাষ করে থাকেন। চলতি বছরে তিনি এগারোটি লিচু গাছ ষাট হাজার টাকা এবং বাকীগুলো চার ও পাঁচ হাজার টাকা করে গাছের মালিকের কাছ থেকে ক্রয় করেছে। গত বছর ৬০টি গাছে তিন লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে তার। এই গাছগুলোতে লিচু চাষ করে বর্তমানে প্রতি শ’ চারশ’-পাঁচশ’ টাকা করে বিক্রি করছেন। তার লিচু কিনার জন্যে ঢাকা, সিলেট ও প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ সহ রাজনৈতিক এবং স্থানীয় জনতা প্রতিদিন ভীড় জমায়।
এছাড়াও একই গ্রামের হেলাল উদ্দিন (৬৬), রুহুল আমিন (৪৬), জিল্লুর রহমান (৫৬), মহর উদ্দিন (৬৬), মাসুদ (৭১), সেনু (৪১), শামসু মেম্বার (৬৬) , বাচ্ছু মিয়া (৬১) ও মহসিন (৫১) এর লিচুর ব্যবসায়ী রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন ব্যবসায়ী তওহিদ। তিনি প্রায় চল্লিশ বছর যাবৎ এই ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছেন। আর অন্যান্যরা কেউ পনেরো বছর আবার কেউ তিন বছর ধরে লিচু ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছেন।
হেলাল উদ্দিন জানান, আমি চল্লিশটি গাছে লিচু চাষ করেছি তার মধ্যে সতেরোটি গাছ পঁচাশি হাজার টাকায় ক্রয় করেছি এবং বিশ হাজার টাকা গাছের পিছনে খরচ করেছি। আমি পনেরো বছর ধরে এই ব্যবসায় রয়েছি। আশা করছি অন্যান্য বছরের মত এবারও লিচু বিক্রি করে লাভবান হতে পারব।
আরাফাত রহমান নাদিম (১৮) জানায়, এই বছরে আমি সোয়া এক লক্ষ টাকার লিচু বিক্রি করেছি। খন্দকার মুখলেছুর রহমান (৭৬) জানান, আমি ১৯৭৫ সন থেকে লিচু ব্যবসার সাথে জড়িত হয়েছি। এবং এই ব্যবসায় আমি লাভবান হয়েছি।
এ
সএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী মো. জুবায়ের হোসেন তামিম (১৮) জানায়, আমি নিজেও এই ব্যবসার সাথে যুক্ত হয়ে ত্রিশ হাজার লিচু খুচরা বিক্রি করেছি। ৩২০টি গাছ দশজন মিলে ৩০ লক্ষ টাকা দিয়ে গাছগুলো ক্রয় করেছি। পরিবার এবং পোল্ট্রি ও মৎস ব্যবসায়ী খন্দকার মো. তারিফুল ইসলাম নওফেল (২৯) এর সহয়তায় সবাই মিলে গাছগুলো কিনেছি। আমাদের সাথে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আল বাব জামান মুফরাতও (১৮) রয়েছে।
স্থানীয় তানভীর আহমেদ (১৮) জানায়, আমার একটা গাছে আটশত লিচু হয়েছে এর মধ্যে নিজেরা খেয়ে এবং আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে দিয়েও অনেক লিচু বাজার বিক্রি করেছি।
এই ঐতিহ্যবাহী লিচুর নাম নিয়ে ব্যবসায়ীরা জানায়, ব্রিটিশ আমলে কে বা কারা চিন দেশে যায় আর সেখান থেকে ফিরে আসার সময় একটি লিচুর চারা সাথে করে নিয়ে আসে আর সেটা এই গ্রামে রোপন করে দেয়। গ্রামবাসী সেই লিচুর বীজ সংরক্ষণে রেখে আস্তে আস্তে বংশ বিস্তার করে আজকের এই লিচু। আর সেই থেকেই মঙ্গলবাড়ীয়ার লিচু নামে পরিচিত।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, মঙ্গল শাহ নামে এক ব্যক্তি এই এলাকায় বাস করত আর সেই থেকেই এই এলাকার নামকরণ হয়ে যায় মঙ্গলবাড়ীয়া। তবে মাহে রমজান উপলক্ষ্যে করোনাভাইরাস এর প্রকুপের কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্রেতা না পাওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন তারা।