লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মানব পাচারকারী চক্রের চার হোতাকে আটক করেছে র্যাব। মঙ্গলবার (২ জুন) রাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে র্যাব-১৪ ভৈরব ক্যাম্পের সদস্যরা তাদের আটক করেন। এ নিয়ে ভৈরবে দায়ের করা মামলায় আটজনকে আটক করা হলো।
আটকরা হলেন- ভৈরবের শম্ভুপুর এলাকার মৃত আব্দুল আহাদ মিয়ার ছেলে হেলাল মিয়া (৪৫), তাতারকান্দি এলাকার মৃত আব্দুর রশিদের ছেলে খবির উদ্দিন (৪২), লক্ষীপুর এলাকার মৃত সুরুজ মিয়া সরকারের ছেলে শহিদ মিয়া (৬১) ও শম্ভুপুর এলাকার জাফরের স্ত্রী মুন্নি আক্তার রুপসী (২৫)।
বুধবার (৩ জুন) দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব-১৪ এর সিও লে. কর্নেল এফতেখার উদ্দিন এসব তথ্য জানান। সংবাদ সম্মেলনে ভৈরব ক্যাম্পের অধিনায়ক রফিউদ্দীন মোহাম্মদ যোবায়ের, উপ-অধিনায়ক চন্দন দেবনাথসহ র্যাবের উধ্বর্তন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
লে. কর্নেল এফতেখার উদ্দিন জানান, নিহত মোহাম্মদ আলী ও মাহবুব এবং আহত জানু মিয়া মানবপাচারকারী মো. হেলাল মিয়া ও মো. খবির উদ্দিনের মাধ্যমে অবৈধভাবে প্রতিজন তিন লাখ টাকা দিয়ে লিবিয়া যায়। নিহত সাকিব, আকাশ, শাকিল এবং আহত সোহাগ দালাল তানজিল (বর্তমানে লিবিয়ায়), নাজমুল (তানজিলের ভাতিজা), জুবুর আলী এবং মিন্টু মিয়ার মাধ্যমে প্রতিজন চার লাখ টাকার চুক্তিতে অবৈধভাবে লিবিয়া যায়। নিহত রাজন চন্দ্র দাস কুখ্যাত দালাল জাফর ও তার স্ত্রী মুন্নি আক্তার রুপসী, মানিক, হিরা এবং শহিদ মিয়ার মাধ্যমে ৪ লাখ টাকা দিয়ে অবৈধভাবে লিবিয়া যায়।
মানিক ও জাফর লিবিয়ায় থেকে মানবপাচারে নেতৃত্ব দেন এবং বাংলাদেশে তাদের হয়ে লোক সংগ্রহ করা, আর্থিক লেনদেনসহ যাবতীয় কাজ পরিচালনা করতেন শহিদ মিয়া, হিরা, মুন্নি আক্তার রুপসী এবং হযরত আলী। বাংলাদেশে তানজিলের মানবপাচার কারবার পরিচালনা করতেন তার ভাতিজা নাজমুল, জুবুর আলী এবং মিন্টু মিয়া।
যেভাবে লিবিয়ায় পাঠানো হয় : বাংলাদেশ হতে লিবিয়ায় পাঠানোর ক্ষেত্রে এই চক্রের সদস্যরা বেশ কয়েকটি রুট ব্যবহার করে থাকে। সেই রুটগুলো তারা সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী মাঝে মধ্যে পরিবর্তন অথবা নতুন রুট নির্ধারণ করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে লিবিয়াতে পাঠানোর ক্ষেত্রে যে রুটটি ব্যবহার হয়ে আসছে বলে জানায়, তা হলো বাংলাদেশ-কলকাতা-মুম্বাই-দুবাই-মিশর-বেনগাজী-ত্রিপলী (লিবিয়া)। দুবাইয়ে পৌঁছে তারা বিদেশি এজেন্টদের তত্ববধানে ৭-৮ দিন অবস্থান করে। বেনগাজীতে পাঠানোর জন্য বেনগাজী থেকে এজেন্টরা কথিত ‘মরাকাপা’ নামক একটি ডকুমেন্ট দুবাইতে প্রেরণ করে। যা দুবাইয়ে অবস্থানরত বিদেশি এজেন্টদের মাধ্যমে ভিকটিমদের নিকট হস্তান্তর করা হয়। এরপর সেই ডকুমেন্টসহ বিদেশি এজেন্ট তাদেরকে মিশর ট্রানজিট নিয়ে বেনগাজী পাঠায়। বেনগাজীতে বাংলাদেশি এজেন্ট তাদেরকে বেনগাজী থেকে ত্রিপলিতে স্থানান্তর করে।
লিবিয়া হতে ইউরোপ প্রেরণ : ভিকটিমরা ত্রিপলিতে পৌঁছানোর পর ত্রিপলিতে অবস্থানরত বাংলাদেশি কথিত কয়েকজন এজেন্ট তাদের গ্রহণ করে থাকে। তারা ত্রিপলিতে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করেন। এরপর ত্রিপলিতে অবস্থানকালীন সময়ে বর্ণিত এজেন্টদের দেশীয় প্রতিনিধির দ্বারা ভিকটিমদের আত্মীয়-স্বজন হতে অর্থ আদায় করে থাকে। এরপর ভিকটিমদের ত্রিপলির বন্দর এলাকায় একটি সিন্ডিকেটের নিকট অর্থের বিনিময়ে ইউরোপে পাচারের উদ্দেশ্যে তাদেরকে হস্তান্তর করে। এরপর উক্ত সিন্ডিকেট সমুদ্রপথে অতিক্রম করার জন্য নৌযান চালনা এবং দিক নির্ণয়যন্ত্র পরিচালনাসহ আনুসাঙ্গিক বিষয়ের ওপর নানাবিধ প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। একটি নির্দিষ্ট দিনে ভোর রাতে এক সঙ্গে কয়েকটি নৌযান লিবিয়া হয়ে তিউনিশিয়া উপকূলীয় চ্যানেলের হয়ে ইউরোপের পথে রওনা দেয়। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পথে গমনকালে ভিকটিমরা ভূমধ্যসাগরের মাঝে মধ্যেই দুর্ঘটনার শিকার হয় এবং জীবনাবসানের ঘটনা ঘটে থাকে।