কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামে পৃথক স্থানে ধর্ষণের পর ছাত্রীসহ দুই কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা। উপজেলার কাস্তুল ও দেওঘর ইউনিয়নে এই পৃথক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
অষ্টগ্রাম উপজেলার দেওঘর ইউনিয়নের এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কিশোরী (১৫) ধর্ষণের শিকার হয়ে ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ধর্ষিতা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কিশোরীকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে জাসেম মিয়া (২১) তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে একাধিকবার ধর্ষণ করে।
ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পরিবার, পুলিশ ও মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ধর্ষক জাসেম দেওঘর ইউনিয়নের মোল্লা বাড়ীর আলমগীর মিয়ার পুত্র। এ বছরের ৩ জানুয়ারী (শুক্রবার) বিকালে ধর্ষক জাসেম অর্থ ও পোশাকের প্রলোভন দেখিয়ে হাজী এমরান মিয়ার দোচালা টিনের ঘরে নিয়ে ধর্ষিতা কিশোরীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে। পরে নানা সময়ে ধর্ষক জাসেম একাধিকবার মেয়েটির সাথে শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হয়। একপর্যায়ে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পরে। বর্তমানে সে ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
ঘটনা অনুসন্ধানে জানা যায়, ধর্ষিতা মেয়েটির পিতা নজর আলী (৭০) পেশায় একজন ভিক্ষুক। নিজের কোনো জমিজমা না থাকায় বিভিন্ন মানুষের জায়গায় আশ্রয় বানিয়ে জীবন যাপন করেন। তারই প্রেক্ষিতে সে দেওঘর ইউনিয়নের মোল্লা বাড়ীর হাজী এমরান মিয়ার বাড়িতে বর্তমানে আশ্রয়াধীন আছেন। তার এই দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে ধর্ষক জাসেম প্রায়ই ভিক্ষুক নজর আলীর ঘরে যাওয়া আসা করতো। এক পর্যায়ে তার কিশোরী মেয়েকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে মেয়েটির সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে এবং কাউকে না বলার জন্য কিশোরীকে নিষেধ করে। ধর্ষণের শিকার কিশোরী বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ায় সে কাউকে কিছু না বলে চুপ থাকে। ঘটনার কয়েক মাস পেরিয়ে গেলে মেয়েটির শারীরিক পরিবর্তন ধরা পরলে ধর্ষক জাসেম কর্তৃক একাধিকবার ধর্ষণের কথা সে স্বীকার করে।
পরে এ বিষয়ে গত ২০ জুন (শনিবার) অষ্টগ্রাম মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ২০০৩ (সংশোধনী) আইনে ৯(১) ধারায় ধর্ষণের শিকার কিশোরীর পিতা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন (মামলা নং-৬)। মামলা দায়েরের খবরটি জানাজানি হলে ধর্ষক জাসেমের পরিবার ধর্ষিতার পরিবারকে নানা ধরণের ভয় ভীতি ও হুমকি প্রদর্শণ করে আসছে বলে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পরিবার জানায়।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আসাদুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মামলা নথিভূক্ত করা হয়েছে। কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসাপাতালে তার শারীরিক পরীক্ষা করা হয়েছে। ঘটনার বিষয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সিনিয়র ম্যাজিসট্রেট আদালত নং-৪ এ হাজির করা হলে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট তাসলিম আক্তার ধর্ষণের শিকার কিশোরীর ২২ ধারায় জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করেন। আসামী গ্রেপ্তারের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
এছাড়া অষ্টগ্রাম উপজেলার কাস্তুল ইউনিয়নের মসজিদজাম এলাকার সোনারু হাটি গ্রামের এক কিশোরী (১৩) গণধর্ষণের শিকার হয়ে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ঘটনা ধামাচাপা দিতে তৎপর স্থানীয় প্রভাবশালী মহল।
ভিকটিম কিশোরী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, কিশোরী মেয়েটি স্থানীয় অষ্টগ্রাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। এ বছরের ১৬ জানুয়ারী (বৃহস্পতিবার) রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলে পাশের বাড়ির দু ধর্ষক কিশোরীর নিজ ঘরে প্রবেশ করে দড়ি দিয়ে মেয়েটিকে বেঁধে ফেলে। প্রথমে মনসুর ও পরে নজরুল হত্যার হুমকি দিয়ে মেয়েটিকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। মেয়েটির চিৎকারে ধর্ষনের বিষয়টি এলাকাবাসী টের পেয়ে গেলে দুই ধর্ষক দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে
পালিয়ে যায়।
ভিকটিম কিশোরীর মা আছমা বেগম জানায়, “আমার স্বামী আমি ও আমার মেয়েকে ফেলে রেখে অন্যত্র বিয়ে করে চলে যায়। ফলে মেয়েটিকে নিয়ে আমি একেবারেই দরিদ্র অবস্থায় দিনাতিপাত করছি। যার কারণে সংসার চালানোর দায়ে ঢাকার গুলশান এলাকায় একটি বাসায় গৃহ পরিচালিকার কাজ করি। ছুটিতে মাঝে মধ্যে বাড়িতে আসি। মেয়েটি বাড়িতে একা থেকে স্কুলে লেখাপড়া করে। আমার মেয়ে একা থাকার বিষয়টি ধর্ষক মনছুর বাড়ির পাশে হওয়ায় আগে থেকেই জানতো এবং সেই সুযোগে সে ও নজরুল মিলে আমার মেয়ের এমন সর্বনাশ করেছে।
তিনি আরো জানান, আমি সু-বিচার ও সামাজিক লজ্জার কারণে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অবহিত করি। কিন্তু তারা আমাকে এর সুষ্ঠু বিচারের আশা দিয়ে একাধিক তারিখ দিয়ে কালক্ষেপন করতে থাকে। ঘটনার কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো ধরণের মীমাংসায় আসতে পারেন নি।
এদিকে মেয়েটির শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকলে আমার সন্দেহ হয়। পরে স্থানীয় একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে মেয়েটিকে গর্ভকালীন পরীক্ষা করালে রিপোর্টে আমার মেয়ে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বলে জানতে পারি। বিষয়টি মীমাংসা না করে বরং উল্টো আমাদের উপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করছে ধর্ষকের পরিবার ও স্থানীীয় একটি প্রভাবশালী মহল।
ঘটনা অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, কিশোরীর পরিবারের দরিদ্রতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল বিষয়টিকে নানাভাবে ধামাচাঁপা দেয়ার লক্ষ্যে কিশোরীর পরিবারকে মোটা অংকের টাকাসহ বিভিন্ন প্রলোভনের মাধ্যমে ভয়ভীতি প্রদর্শণ করছে।
অষ্টগ্রাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নাসিমা আক্তারের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বিষয়টি আমি অবগত হয়েছি। ধর্ষণের শিকার মেয়েটির মা আমাকে বিষয়টি জানিয়েছে। মেয়েটি আমার বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী। সমাজের এমন অবক্ষয় এই প্রজন্মকে বিপথে নিচ্ছে। মেয়েটি যাতে সুবিচার পায় সে বিষয়ে আমার বিদ্যালয় মেয়েটির পাশে থাকবে।
এ বিষয়ে কাস্তুল ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল হক রন্টির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বিষয়টি আমি অবগত হয়েছি। এটা আইনের বিষয়, আইনগত কোনো ব্যবস্থা হলে আমি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সার্বিক সহযোগিতা করবো। ঘটনাটি অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে ধামাচাপা দেয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানিনা।
অষ্টগ্রাম উপজেলা নারী নেত্রী অধ্যাপিকা সৈয়দা নাসিমা রীতা আক্ষেপের সাথে জানান, অষ্টগ্রাম উপজেলায় ইদানিং ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা আশংকাজনক ভাবে বেড়ে গেছে যা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। তার উপর কোনো ঘটনা ঘটলেই টাকা পয়সা লেনদেনের মাধ্যমে বা ভিকটিমের পরিবারকে হুমকি দিয়ে ধামাচাপার বিষয়টিতো আমাদের বার বারবার ভাবিয়ে তুলছে। স্থানীয় একটি মহল ধামাচাপার বিষয়ে সবসময় তৎপর। তাদের এসব কর্মকান্ডে এলাকায় সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দেখতে চাই। সুষ্ঠু বিচার না হলে কঠোর আন্দোলনে যেতেও পিছ পা হবো না।
অষ্টগ্রাম মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম মোল্যা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, দুটি ঘটনা আমি অবগত হয়েছি। দেওঘর ইউনিয়নের ঘটনায় ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পিতা বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন। মেয়েটিকে মেডিকেল পরীক্ষা করার জন্য পাঠানো হয়েছে এবং মেয়েটির জবাবন্দী নেয়া হয়েছে। আমি মৌখিকভাবে কাস্তুল ইউনিয়নের মসিজদজাম এলাকার গণধর্ষণের বিষয়টি শুনেছি। তবে এ বিষয়ে ভিকটিমের পরিবার লিখিত কোনো অভিযোগ দায়ের করেননি। লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। দুটো ঘটনায় জড়িত আসামীরা পলাতক রয়েছে। আসামীদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আশা করি খুব দ্রুত আসামীদের গ্রেফতার করতে পারবো।