ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার শুরুতে লোক সমাগম যে আশা জাগিয়েছিল ব্যবসায়ীদের মনে, বেচাকেনায় সেই মিল না পেয়ে তাদের অনেকেই হতাশ।
স্টল মালিকদের কেউ কেউ বলেছেন, এবার দর্শক সমাগম বেশি হলেও ক্রেতাদের খরচের প্রবণতা ছিল কম; তাই বেচাবিক্রিও আশানুরূপ হয়নি।
অবশ্য সুনির্দিষ্ট কিছু পণ্যের স্টল ও প্যাভিলিয়নে মেলার পুরো মাসজুড়ে ক্রেতা-দর্শনার্থীদের ভিড় লেগে থাকতে দেখা গেছে। ‘ভালোরকম’ বেচাবিক্রির কথাও শোনা গেছে তাদের মুখে।
মাসের শেষ শুক্রবার বাণিজ্যমেলা ঘুরে এবং কথা বলে আশা-হতশার নানা সুর শোনা গেছে বিক্রেতাদের কণ্ঠে।
এবারের মেলায় পুরো মাসজুড়ে ক্রেতাদের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল ক্রোকারিজপণ্য, প্লাস্টিকপণ্য, বিদেশি পোশাক ও ফার্নিচারের স্টলগুলো।
তাছাড়া প্রসাধনী, মেয়েদের পোশাক ও অলঙ্কারেরও বেশ চাহিদা ছিল বলে স্টলকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে। মাসশেষে এসব স্টলের মালিকদের মুখে সন্তুষ্টির হাসি দেখা গেল শুক্রবার।
লাখ লাখ টাকা খরচ করে দেশীয় থ্রি-পিসের শোরুম দিয়ে বেশ লোকসানে পড়ার দাবি করেছেন অনেক ব্যবসায়ী।
মেলার পূর্বপ্রান্তে অপি কালেকশান নামে একটি প্যাভিলিয়নের স্বত্ত্বাধিকারী মতিন সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার দোকানে মূল্যছাড়ের পর আড়াইশ’ টাকা দরের থ্রিপিসও ছিল। কিন্তু ক্রেতাদের তেমন সাড়া দেখা যায়নি।“শুধু আমি একা নই। খোঁজ নিয়ে দেখেন, এবারের মেলায় অধিকাংশ পোশাকের শোরুমগুলো ক্ষতির মুখে। লোকজনের পছন্দের তালিকায় দেশীয় থ্রিপিস নেই।”
নিজের লোকসানের কারণ ব্যাখ্যা করে এই ব্যবসায়ী বলেন, “কারসাজির কারণে আমরা প্রকৃত ব্যবসায়ীরা প্যাভিলিয়ন পেলাম না। পরে দালাল ধরে ২/৩ গুণ বেশি টাকা দিয়ে (প্রায় ১৫ লাখ) এই স্টল সাজিয়েছি। দিনে ২/৪ লাখ টাকার বেচাকেনা না হলে লাভ কীভাবে হবে?”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেলায় লটারির মাধ্যমে স্টল পেয়ে অনেকেই তা চড়ামূল্যে অন্যদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। আর সেসব স্টলই কিনেছেন অনেকে।
সদ্য চালু হওয়া প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়াম অ্যালুমিনিয়ামের নতুন রান্নার পাত্রগুলো নিয়ে স্টল সাজিয়েছিলেন হাসান মাহমুদ। তবে নিজেদের কারখানায় ননস্টিকি পাত্র উৎপাদনের কথা থাকলেও বিভিন্ন জটিলতার কারণে মেলায় তা আনা সম্ভব হয়নি।
মাহমুদ জানান, মেলায় তাদের তেমন বেচাকেনা হয়নি। ভালো মানের পণ্যগুলো না আসা এর অন্যতম কারণ।
আশপাশের ক্রোকারিজ স্টলগুলোতে বেশ বেচাকেনা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, কেবল ‘ট্রাডিশনাল’ অ্যালুমিনিয়ামপাত্র রাখলে লোকজন ভিড়তে চায় না।
শ্রীহা কুলম্যাট ইন্ডাস্ট্রিজের মামুন কবির জানান, মেলায় দেশে তৈরি শীতলপাটি ও ম্যাটের বেশ কাটতি ছিল। আশানুরূপ বেচাকেনা না হলেও লাভেই আছেন তিনি।
১টি কিনলে ১০টি ফ্রি
মেলায় বড় বাজেটের বেচাকেনার মধ্যে ওভেন, জুস মেকার, সবজি কাটার, ওয়াটার পিউরিফায়ার, ননস্টিক পাত্রের একটি বান্ডেল ছিল বেশ লক্ষ্যনীয়। ২০ থেকে ২২ হাজার টাকায় ১০ থেকে ১১টি পণ্যের এই বান্ডেল দেদার বিক্রি হচ্ছিল শেষ দিনগুলোতে।
শুক্রবারও মাত্র ১০ মিনিটের মাথায় তিনটি বান্ডেল বিক্রি হতে দেখা গেছে জার্মানির প্রতিষ্ঠান ওয়েলবার্গের একটি স্টলে।
অনেকটা চাঙ্গা মেজাজে ওয়েলবার্গের কর্মী মাসুম জানান, অনেক ছাড়ে পণ্য দিয়ে দিচ্ছি। লাভ-লোকসান কাটায় কাটায়। আগামী ২/৩ দিন কী হয় দেখা যাক।
বেচাকেনা নিয়ে একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা শোনান সূর্য বুটিকসের মালিক টুটুল। দেশি বিদেশি আসবাবপত্রের পাশাপাশি কিছু হাতে তৈরি পণ্যও রয়েছে তার স্টলে।
আগ্রহ বিদেশিপণ্যে
পূর্বপাশে দেশীয় পোশাকের কয়েকটি স্টলের মালিকরা বেচাবিক্রি নিয়ে হতাশার কথা জানালেও উল্টোচিত্র দেখা গেছে পশ্চিমপাশের বিদেশি প্যাভিলিয়নগুলোতে। ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, ইরানসহ অন্যান্য দেশের স্টলগুলোতে দেখা গেছে কেনাকাটার ধুম।
কারুমেলা নামে প্রসাধনী ও অলঙ্কার দোকানের মাসুদুল আলম বলেন, মেলার বিগত দিনগুলোতে ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকার বেচাকেনা হতে পারে। লাভের পাল্লা ভারি হলেও আরও বিক্রির আশা ছিল তাদের।
সেখানে কথা হয় শাহিন আক্তার নামের এক গৃহিনীর সঙ্গে; ১৫শ’ টাকায় একটি পাকিস্তানি থ্রি-পিস কিনেছেন তিনি।
শাহিন বলেন, “মেলায় বিদেশি স্টলের পণ্যগুলো একটু ডিফ্রেন্ট। থ্রিপিস থেকে শুরু করে অর্নামেন্টস, জুতা, কাপ-পিরিচ-প্লেটগুলোর ডিজাইনও সুন্দর। অনেকে সখ করে এসব কিনে থাকেন।”
ফার্নিচার ব্যবসায়ী আবিদ আলী পাকিস্তানের স্থানীয় ডিজাইনের কাঠের দোলনা, জলচৌকি, টি-টেবিলসহ আরও পণ্য নিয়ে এসেছিলেন মেলায়। ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা শেষে এসব পণ্য নিয়ে চট্টগ্রামের আরেকটি মেলায় অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে তার।
আশানুরূপ বেচাবিক্রি হয়নি বলে এই পাকিস্তানি দাবি করলেও বেচাকেনা যে গতবছরের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে তাও স্বীকার করেন।
“গত বছর ৬ লাখ টাকার মতো সেল হয়েছিল। এবার এখন পর্যন্ত ১২ লাখ টাকার মতো সেল হয়েছে। তবে এধরনের মেলায় আমাদের টার্গেট থাকে আরও বেশি। অন্যথায় লোকসানে পড়তে হয়।”
থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা প্রসাধনী, অলঙ্কার ও মেয়েদের বিভিন্ন নিত্যপণ্যের পসরা সাজিয়ে বেশ ভালো করতে পেরেছেন আতিকুর রহমান। তার দোকানেও দেখা গেছে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়।
মাস শেষে মেলা কেমন হলো জানতে চাইলে আতিক বলেন, খুব ভালো, বেচাকেনাও ভালো হয়েছে।
নতুন বছরের প্রথম দিন ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার পর্দা ওঠে, যাতে ২২ দেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়।
মাসব্যাপী এ মেলা প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত উন্মুক্ত ছিল। প্রাপ্তবয়স্করা ৩০ টাকায় এবং শিশু ও কিশোররা ২০ টাকায় টিকেট কিনে মেলায় ঢুকতে পারছেন।
মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ ডটকম/30-01-2016/মইনুল হোসেন