শুক্রবার মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে সুপার লিগ কোয়ার্টার-ফাইনালে ৫০ ওভারে ৯ উইকেটে ২১১ রান তুলেছিল নেপাল। বাংলাদেশ জিতে যায় ১০ বল বাকি রেখে।
এই প্রথম যুব বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনাল পর্ব পেরোতে পারল বাংলাদেশ। সীমানা আরেকটু বাড়িয়ে দিলে এটি বাংলাদেশের ক্রিকেটেরই অন্যতম সেরা সাফল্য। ক্রিকেটের কোনো বিশ্ব আসরে এই প্রথম সেমি-ফাইনালে উঠল বাংলাদেশ।
৬ উইকেটের জয় আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও রান তাড়ায় ৯৮ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ভীষণ চাপে পড়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ক্রমশ মন্থর হতে থাকা উইকেটে চাপকে জয় করা দুর্দান্ত এক জুটি গড়েন জাকির ও মিরাজ। সময়ের দাবি মেটানো ব্যাটিং করেছেন দুজন, দেখিয়েছেন দারুণ টেম্পারামেন্ট।
ফিটনেসের প্রমাণ রেখে দুজনের রানিং বিটুইন দ্য উইকেট ছিল নজরকাড়া। সিঙ্গেলস-ডাবল নিয়ে আস্তে আস্তে কাছে এনেছেন লক্ষ্য, দূরে ঠেলেছেন চাপ। জুটি জমে ওঠার পর দারুণ কিছু বাউন্ডারিতে মিটিয়েছেন রান-বলের টানাপোড়েন।
দারুণ এক ছক্কায় ম্যাচ শেষ করেই উল্লাসে ফেটে পড়েন জাকির। বাইরে থেকে ছুটে আসেন সতীর্থরা। গ্যালারিতে তখন স্বাগতিক দর্শকদের গর্জন! ৭৭ বলে ৭৫ রান করে অপরাজিত জাকির; ৫৫ রানে অপরাজিত অধিনায়ক মিরাজ। দুজনের ম্যাচ জেতানো অবিচ্ছিন্ন জুটি ১১৭ রানের।
আগের ম্যাচগুলোর মতই শুরুতে অতি সাবধানী ব্যাটিংয়ের পথে হেঁটেছে বাংলাদেশ। বলের পর বল ব্লক হয়েছে; সোজা ফিল্ডারের হাতে গিয়েছে বল। ৬ ওভারে ১৭ রানের উদ্বোধনী জুটির পর আউট হন ওপেনার সাইফ হাসান (২১ বলে ৫)।পিনাক ঘোষ ও জয়রাজ শেখেরও নিজেদের সহজাত ব্যাটিংয়ের চেয়ে মন বেশি ছিল উইকেট আঁকড়ে রাখায়। তাতে রানের চাকা খুব দ্রুত না ঘুরলেও গড়ে ওঠে জুটি। ৭৭ বলে ৪৬ রানের দ্বিতীয় উইকেট জুটি ভাঙে দুই ব্যাটসম্যানের ভুল বোঝাবুঝিতে। প্রথম ম্যচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এই দুজনের সম্ভাবনাময় জুটি শেষ হয়েছিল বাজে রান আউটে। এবারও আরও দৃষ্টিকটুভাবে দুই ব্যাটসম্যানই এক প্রান্তে! সে দিনের মতোই আউট হলেন পিনাক (৫৪ বলে ৩২)।
বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায় খানিক পর। লেগ স্পিনার সন্দিপ লামিছানের শর্ট বলে ফিরতি ক্যাচ দেন দলের সেরা ব্যাটসম্যান নাজমুল হোসেন শান্ত (৮)।
মন্থর উইকেটে ব্যাকফুটে দারুণ খেলছিলেন জয়রাজ। কিন্তু বেশি ব্যাকফুটে খেলার খেসারত দিয়ে হন এলবিডব্লিউ (৬৮ বলে ৩৭)।
চাপ সামলে সেখান থেকেই দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যান জাকির ও মিরাজ।
ব্যাটিংয়ে নেপালকে ভুগিয়েছে বাজে রানিং বিটুইন দা উইকেট। সর্বোচ্চ ৭২ রান করা অধিনায়ক রাজু রিজালসহ চার ব্যাটসম্যান হয়েছেন রান আউট! যার তিনটিই ছিল ব্যাটসম্যানদের তাড়াহুড়োয়।
বরাবরের মতো ক্ষুরধার বোলিং করতে পারেনি বাংলাদেশের স্পিনাররা। তবে স্বাগতিকদের আঁটসাঁট বোলিং আর দারুণ ফিল্ডিং এবং নেপালিদের অনভিজ্ঞতা মিলিয়ে খুব বড় স্কোর হয়নি।
সকালে কিছুটা আর্দ্র ছিল উইকেট। প্রথম তিন ম্যাচে উইকেট না পাওয়া আব্দুল হালিমের জায়গায় বাঁহাতি পেসার মেহেদি হাসান রানাকে একাদশে আনে বাংলাদেশ। নতুন বলে রানা ও মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন বোলিং করেছেন দারুণ। নেপালের শুরুটা ছিল সতর্ক। উইকেট হারায়নি তারা প্রথম ৫ ওভারে।
বাংলাদেশকে প্রথম ব্রেক থ্রু এনে দেন টুর্নামেন্টে দলের সেরা বোলার সাইফুদ্দিন। কাট করে ভেতর ঢোকা বলে প্লেড অন হন সন্দিপ সুনার (৭)। পরের ওভারেই রানার দারুণ এক বাউন্সারের জবাব খুঁজে পাননি যোগেন্দ্র সিং কার্কি (১)।
তৃতীয় উইকেটে ৪৪ রানের জুটিতে নেপাল খানিকটা প্রতিরোধ গড়ে। জমে উঠতে থাকা এই জুটি ভাঙেন নাজমুল হোসেন শান্ত। তবে বল হাতে নন, ফিল্ডিংয়ে। টুর্নামেন্ট জুড়েই অসাধারণ ফিল্ডিং করা শান্তর দুর্দান্ত ফিল্ডিং ও থ্রোয়ে রান আউট হন ওপেনার সুনিল ধামালা (২৫)।
এরপরই নেপাল পায় ইনিংসে তাদের সেরা জুটি। বয়স নিয়ে ওঠা বিতর্ককে সঙ্গী করে দারুণ ব্যাটিং করেছেন অধিনায়ক রাজু রিজাল। আরেক পাশ থেকে সঙ্গ দিয়েছেন আরিফ শেখ। বাংলাদেশের স্পিনারদের অনায়াসে খেলেছেন দুজন।
শেষ পর্যন্ত এই জুটি ভেঙেছে অধিনায়ক মিরাজের বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং পরিবর্তনে। পেসার সাইফুদ্দিনকে ফিরিয়ে আনেন মিরাজ, প্রথম ওভারেই মেলে ফল। উড়িয়ে মারতে গিয়ে ডিপ মিড উইকেটে ধরা পড়েন আরিফ (২১)।রিজালকে ফেরানোর পথই পাচ্ছিল না বাংলাদেশ। পথ করে দেন নেপাল অধিনায়ক নিজেই। টুর্নামেন্টে নিজের প্রথম অর্ধশতক করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, হয়ে উঠছিলেন বাংলাদেশের মাথা ব্যথার কারণ। কিন্তু সতীর্থের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে মাঝ উইকেটে থমকে গিয়ে হলেন রান আউট (৮০ বলে ৭২)। ফিল্ডার যথারীতি শান্ত!
শেষ দিকে দিপেন্দ্র সিং এইরি (২২)ও প্রেম তামাং (২২*) নেপালের রানকে নিয়ে যান দুইশর ওপারে।
২ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্টে নিজের শিকার ৯ উইকেটে নিয়ে যান সাইফুদ্দিন। একটি করে উইকেট নেন সালেহ আহমেদ শাওন গাজী ও প্রথমবার খেলতে নামা রানা।
এমনিতে ধারাবাহিকতার প্রতিমূর্তি হলেও বল হাতে একটি বিবর্ণ দিন কেটেছে মিরাজের। একটি উইকেট নিতে খরচ করেছেন ৫১ রান।
কিন্তু অধিনায়ক সেটা ভুলিয়ে দিয়েছেন অসাধারণ এক ইনিংসে। আর জাকির তো এই ম্যাচকেই বেছে নিয়েছিলেন নিজেকে চেনানোর মঞ্চ হিসেবে। বাংলাদেশও তাই পা রাখল ইতিহাসের মঞ্চে।
মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ ডটকম/05-02-2016/মইনুল হোসেন