বোরো ধানের উৎসবে ভাসছে হাওর। বাতাসে দুলছে সোনালি ধানের শীষ। যেদিকে চোখ যায় কেবল ধান আর ধান। নতুন ধানের গন্ধে মাতোয়ারা চাষি। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে চলছে ধান কাটা। ধান কাটার শ্রমিকরা ছুটছে হাওরে। কিষানিরা মাড়াই করা ধান ওড়াচ্ছে বাতাসে। কিশোরগঞ্জের প্রতিটি হাওরে এখন এমন ছবিই চোখে পড়বে সবার।
এবার বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। ধারণার চেয়ে বেশি ধান পেয়ে খুশি চাষি। শুরু হয়েছে নতুন ধান কাটা। এ ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছে কৃষক। তবে ধানে খুশি হলেও দামে খুশি হতে পারছে না তারা। কষ্টে বোনা ধান বাজারে বেচতে গিয়ে মেজাজ চড়ে যাচ্ছে তাদের। এক ধরনের হতাশায় ভুগছে কৃষক। সরকার ধানের দাম নির্ধারণ করে দিলেও এ দামে ধান বিক্রি হচ্ছে না কোথাও। বর্তমান বাজার দরে ধান বেচলে লোকসান গুনতে হবে তাদের। এরপরও ধার-দেনার চাপে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে অসহায় কৃষক। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত থেকে চাল আমদানি আপাতত বন্ধ না হলে কৃষকরা ধানের কাঙ্ক্ষিত দাম পাবে না। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, মিলাররা ধান কেনা শুরু করলেই ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু।ধানে খুশি, দামে ধরাধান কাটা উৎসবে পিছিয়ে নেই স্কুলের শিক্ষার্থীরা। ছবি : কালের কণ্ঠ
বছরের একটি মাত্র বোরো ফসলের ওপরই নির্ভর করে হাওরবাসী। তাই সর্বস্ব ঢেলে দিয়ে বোরো আবাদ করে তারা। প্রকৃতির আনুকূল্য পাওয়ায় ফসলও খুব ভালো হয়েছে এবার। তবে পাহাড়ি ঢল ও আগাম বন্যার ভয় তাড়া করছে কৃষকদের। কিছু জমিতে এরই মধ্যে হাঁটু সমান বৃষ্টির পানি জমেছে। পানি উপেক্ষা করেই কৃষকদের কাটতে হচ্ছে ধান। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘরে তুলতে হবে এ ধান। যারা বিআর-২৮ ও অন্যান্য আগাম জাতের ধান রোপণ করেছিলেন, ওই সব জমিতে পুরোদমে শুরু হয়েছে ধান কাটা। আগামী একটা মাস নাওয়া-খাওয়া ভুলে তাদের পড়ে থাকতে হবে মাঠে।
করিমগঞ্জের নিয়ামতপুর ইউনিয়নের রৌহা গ্রামের কৃষক নবী হোসেন জানান, তিনি দুই একর জমিতে বোরো ধান করেছেন। ফসল খুব ভালো হয়েছে। তবে বাজারের অবস্থা ভালো নয়। ধার-দেনা করে চাষাবাদ করতে হয় তাঁদের। ধানের দাম না পেলে মাঠে মারা যাবেন তাঁরা। তিনি জানান, ফসল ঘরে তোলার আগেই পাওনাদাররা চাপ দিতে থাকে। আছে ধান কাটা ও পরিবহনের খরচ। তাই বৈশাখের শুরুতেই ধান বেচতে হয় তাঁদের। কিন্তু সমস্যা হলো এ সময়টায় ধানের দাম পাওয়া যায় না।
জানা গেছে, সরকার ধান ও চালের দাম কেজিপ্রতি যথাক্রমে ১৮ ও ৩২ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও, বাজারে এ দাম পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারে নতুন ধান ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ এক মণ ধান আবাদ করতে কৃষকের খরচ হয়ে যায় ৫০০ টাকার মতো।
পাহাড়ি ঢল কিংবা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এক মাসের মধ্যে হাওরের ধান কাটা শেষ হবে। এ সময়টা কৃষকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাড়ির কেউ তখন বসে থাকে না। গৃহবধূ থেকে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও ধান কাটা, বাড়ি নেওয়া ও মাড়াইয়ের কাজে নেমে পড়ে।
ইটনা বরিবাড়ী গ্রামের কৃষক আবদুল আহাদ জানান, কৃষিকাজ না করে কৃষক বসে থাকতে পারে না। তাই লাভ-লোকসানের হিসাব না করে প্রতি বছরই বোরো আবাদ করেন তাঁরা।
করিমগঞ্জের উত্তর গণেশপুর গ্রামের কৃষক রহম আলী ও জজ মিয়ার কৃষিকাজ বিলপায়া হাওরে। দুজনে মিলে এবার ১৪ একর জমিতে বোরো ফলিয়েছেন। ফসল ভালো হওয়ায় বেজায় খুশি তাঁরা। হাসিমুখে বলেন, তাঁদের জমিতে প্রায় হাজার মণ ধান হবে। কিন্তু দাম কম থাকায় কিছু ধান বেচে বাকি ধান রেখে দেবেন। বাজার পরিস্থিতি ভালো হলে, পরে বিক্রি করবেন। তবে যারা ধারকর্জ করে কৃষিকাজ করেছে, এ ধরনের ছোট কৃষকদের ঋণের কারণে ধান বেচতেই হবে।
করিমগঞ্জ চামড়াবন্দর এলাকার ধান ব্যবসায়ী মো. সাইফুল ইসলাম নিম্ন্নমুখী ধানের দরের কথা স্বীকার করে জানান, ভারত থেকে সরকার চাল আনছে। ব্যবসায়ীরা প্রচুর চাল আমদানি করছেন। তাই মিল মালিকরা বোরো ধানের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। আরেক ধান ব্যবসায়ী আহসান হাবিব রতন জানান, কৃষকদের জন্য তাঁদেরও খারাপ লাগছে, কিন্তু কিছু করার নেই।
কয়েকজন কৃষক বলেন, যখন চাষির হাতে ধান থাকে, তখন দাম কমে যায়। ধান কৃষকের হাত থেকে চলে গেলে দাম বাড়ে। তাঁদের দাবি, সরকারের উচিত এ ধরনের প্রবণতা বন্ধ করা। কৃষকরা মনে করেন, সরকার নির্ধারিত দামে কেনাবেচা নিশ্চিত করা না গেলে ভবিষ্যতে ধানচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন চাষিরা।
কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক অমিতাভ দাস জানান, কিশোরগঞ্জে এ বছর বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ৬৪ হাজার ৫৮১ হেক্টর। আবাদ হয়েছে এক লাখ ৬৬ হাজার ২৮৫ হেক্টর জমিতে। বাম্পার ফলন হওয়ায় এবার সাত লাখ টন চাল উৎপাদন হবে- যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। তবে তিনি ধানের দামের ব্যাপারে আশাবাদ জানিয়ে বলেন, ‘মাত্র তো ফসল কাটা শুরু হলো, আশা করি মিল মালিকরা বসে থাকবেন না। তাঁরাও ধান কিনতে মাঠে যাবেন। তখন কৃষকরা ঠিকই ধানের ন্যায্য মূল্য পাবে।
মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ/ এম ইউ