muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

আইন আদালত

ছয় জেলায় বিচারিক তদন্তের নির্দেশ

দুর্গাপূজা চলাকালে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ছয় জেলায় বিচারিক তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। জেলাগুলো হচ্ছে কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও রংপুর। এসব জেলার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) অথবা মুখ্য বিচারিক হাকিমকে (সিজেএম) তদন্ত করে ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে উসকানিমূলক পোস্ট সরানো এবং সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় বিচারিক তদন্ত চেয়ে করা এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোর্শেদ।

আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, রুলে হিন্দুদের দুর্গাপূজা প্যান্ডেল, মন্দির, বাড়ি, জীবন এবং সম্পত্তি রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা কেন অবৈধ হবে না এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের জীবন, উপাসনালয় এবং সম্পত্তি রক্ষায় কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়েছেন আদালত। চার সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, ধর্ম সচিব, সংশ্লিষ্ট ৬টি জেলার ডিসি ও এসপিসহ ২১ বিবাদীকে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এর আগে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বিনষ্টের উদ্দেশ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া সব ধরনের উসকানিমূলক পোস্ট ও ভিডিও অপসারণের নির্দেশনা চেয়ে ২১ অক্টোবর হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট অনুপ কুমার সাহা ও মিন্টু চন্দ্র দাশের পক্ষে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এ রিট দায়ের করেন। গতকাল রিটের ওপর শুনানি হয়। শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, রিটে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় রাষ্ট্রের ইচ্ছাকৃত ব্যর্থতা রয়েছে বলে

উল্লেখ করা হয়েছে। সরকার কি এগুলো চেয়েছে? আমরা আবেদন থেকে কতকগুলো শব্দ প্রত্যাহারের দাবি জানাই। ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেছেন, নির্দোষ ভুক্তভোগীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের বক্তব্য প্রকাশ করে যেহেতু ওই সময় মূলধারার গণমাধ্যম এগুলো ব্ল্যাক আউট করে। ফলে রিট পিটিশনারদের কাছে যেসব তথ্য আসে সেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে এসেছে। সহিংসতার এরিয়াগুলোয় ভুক্তভোগীরা পুলিশের নিরাপত্তা চায়। কিন্তু পুলিশ আসেনি। সে কারণে এটা তাদের চিন্তা। কিন্তু সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনই এটা করেছে, তা বলেনি। তা ছাড়া এখানে সরকার বলতে পুরো সরকারকে বোঝানো হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ স্থানীয় প্রশাসনকে বোঝানো হয়েছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল এ সময় বলেন, উনি বলছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেছে। তা হলে সে বক্তব্য কোথায়? এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কি তারা এখানে যুক্ত করেছে? তা হলে কীভাবে বলে? সে এভাবে কেমন করে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছে? এগুলোর প্রমাণ আনতে হবে। আদালত এ সময় জানতে চান আরও কি কোনো আপত্তি আছে? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বেশ কয়েকটি জায়গায় আপত্তি তুলে ধরে বলেন, রিটের ১৬ নম্বর প্যারাগ্রাফে বলা হয়েছে, অধিকাংশ ঘটনার ক্ষেত্রে পুলিশ কিংবা স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কারও সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। এভাবে তো বলা যায় না। এর তো প্রমাণ আনতে হবে। প্যারাগ্রাফে ৪১-এ বলা হয়েছে, এসব নাগরিকের রক্ষায় রাষ্ট্রের ইচ্ছাকৃত অবহেলার দায় অবশ্যই রাষ্ট্রকে নিতে হবে। এখানে রাষ্ট্রের ইচ্ছাকৃত অবহেলা বলা হচ্ছে। রাষ্ট্রের একটা অঙ্গের কথা বলতে পারেন, কিন্তু রাষ্ট্র কীভাবে বলে? তা ছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়কে রক্ষায় রাষ্ট্রের কোনো অবহেলা নেই। রাষ্ট্রের ব্যর্থতা দেখাতে হবে।

এ সময় অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোর্শেদ বলেন, রাষ্ট্র নিশ্চুপ নেই। মামলা করেছে। কুমিল্লায় গ্রেপ্তার করেছে। স্বীকারোক্তি দিয়েছে। সেখানে রাষ্ট্রের ইচ্ছাকৃত অবহেলা বলে কী করে? রাষ্ট্রকে তো ম্যালাইন করতে পারে না। রিটের প্রার্থিত অংশ তুলে ধরে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, কুমিল্লা ও রংপুরসহ সব জায়গায় গ্রেপ্তার হয়েছে। প্রতিটি মামলা মনিটর করা হচ্ছে। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন বলেন, আমরা গর্ব করে বলতে পারি, আমদের দেশে এটা ছিল না। এটা একটা ঘটনা ঘটেছে। আর এটা তো ঘটানো হয়েছে। সরকার এ ঘটনায় অ্যাকশন নিয়েছে।

আদালত এ সময় অতীতে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর কিছু সহিংসতা ঘটে ছিল উল্লেখ করে, ওইসব ঘটনার ক্ষেত্রে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এবারের ক্ষেত্রে সরকার অনেক দুষ্কৃতীকে গ্রেপ্তার করেছে। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে, তদন্ত চলছে এবং যথাযথভাবে তদন্ত করে পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করবে। আদালত অতীতের ঘটনায় যেসব মামলা করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে, সেগুলোর অবস্থা জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সেগুলোর বিচার চলছে। এ সময় রিটকারীর আইনজীবী রামুর ঘটনার বিষয়টি উল্লেখ করতে চাইলে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোর্শেদ আদালতে বলেন, পুরো আবেদন পড়লে দেখা যায় বর্তমান বিষয়টি শুধু কুমিল্লার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আগের ঘটনার বিষয়টি এখানে নেই।

এর পর রিটকারীর আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া সংবিধানের বিধান তুলে ধরে বলেন, শুধু সরকার নিয়ে রাষ্ট্র নয়। অ্যাটর্নি জেনারেল মনে করছেন রাষ্ট্র মানেই শুধু সরকার। আমরা সরকারকে ম্যালাইন করছি না। স্ট্যাটুয়ারি পাবলিক অথরিটিও এখানে জড়িত। তিনি আরও বলেন, ২০০১ সালে নির্বাচনের পর যে সহিংসতা ঘটেছিল সেটাসহ গত ২০ বছরে সংহিংসতার ঘটনায় প্রায় ৮৩ হাজার মামলা হয়েছে। কিন্তু একটিরও আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি। ২০১২ সালে রামুতে ঘটে যাওয়া সহিংসতার ঘটনায় আমি নিজে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করে একটি পিটিশন দাখিল করি। সরকারও এ ঘটনার তদন্ত করে। ১৯টি মামলা হয়েছে। কিন্তু ৯ বছর পার হলেও আজও একটি মামলারও বিচার শুরু হয়নি।

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আরও বলেন, কুমিল্লার ঘটনার পর এ পর্যন্ত ২৬ হাজার লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে এসেছে। আমি এর সঙ্গে সিরিয়াসলি দ্বিমত পোষণ করি। ৬ হাজার লোকও এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিনা সন্দেহ আছে। প্রকৃত অপরাধীদের পুলিশ ধরছে না। তিনি বলেন, এখানে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। দেশে আইন আছে। এ অপরাধ দমনের দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনের। নাগরিকের জান ও মালের নিরাপত্তার অধিকার সাংবিধানিক। আদালত উভয়পক্ষের শুনানি গ্রহণ শেষে উপরোক্ত আদেশ দেন।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ছয় জেলায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৬৫টি মামলা হয়েছে। জেলাওয়ারি মামলাগুলো হলো নোয়খালীতে ২৯, কুমিল্লায় ১১, চট্টগ্রামে ৭, ফেনীতে ৪, চাঁদপুরে ১০ ও রংপুরে ৪টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৭ হাজার ৩৩৩ জনকে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৬৩৯ জনকে।

Tags: