muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

জাতীয়

চারটি ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করে চক্রটি

ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত চক্রের পাঁচজনকে গ্রেফতার শেষে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) জানিয়েছে, তাদের তিনজনই সরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা। পরপর ব্যাংকের চারটি নিয়োগ পরীক্ষাতেই প্রশ্নফাঁস করেছে চক্রটি।

ডিবির প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। জড়িত সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রশ্নপত্র প্রণয়নসহ পরীক্ষা আয়োজনে দায়িত্বপ্রাপ্ত আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজির আইসিটি বিভাগ থেকে প্রশ্নফাঁস হয়েছে। চক্রটি এ পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ৬০ কোটি টাকা।

বুধবার বিকেলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার।

গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগের জোনাল টিম ৬ নভেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বিশেষ অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতাররা হলেন, মূলহোতা আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি টেকনিশিয়ান মোক্তারুজ্জামান রয়েল (২৬), জনতা ব্যাংকের গুলশান শাখার অফিসার শামসুল হক শ্যামল (৩৪), রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার জানে আলম মিলন (৩০), পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান মিলন (৩৮) ও চাকরিপ্রার্থী স্বপন।

সংবাদ সম্মেলনে হাফিজ আক্তার বলেন, পাঁচটি ব্যাংকে অফিসার ক্যাশ পদে এক হাজার ৫১১ জন জনকে নিয়োগ দিতে ৬ নভেম্বর বিকেলে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বিকেল তিনটা থেকে চারটা পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র তৈরি ও পুরো পরীক্ষা সম্পাদনের দায়িত্বে ছিল আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি।

পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হবে- ৫ নভেম্বর রাতে এমন তথ্য আসে ডিবির কাছে। ডিবির টিমের সদস্যরা ছদ্মবেশে পরীক্ষার্থী সেজে ৬ নভেম্বর সকাল সাতটার দিকে প্রশ্নপত্রসহ উত্তর পাওয়ার জন্য চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। অগ্রিম টাকা পরিশোধের পর প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা রাইসুল ইসলাম স্বপন পরীক্ষার্থীকে নিয়ে যান। এরপর পরীক্ষার উত্তরপত্রসহ স্বপনকে হাতেনাতে আটক করা হয়।

৬ নভেম্বর পরীক্ষায় আসা প্রশ্নের সঙ্গে সকালে পাওয়া প্রশ্ন ও উত্তর হুবহু মিলে গেলে স্বপনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রূপালী ব্যাংকের সাভার শাখার শ্রীনগর থেকে জানে আলম মিলনকে গ্রেফতার করা হয়। রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার জানে আলম মিলনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে অভিযান চালানো হয়। তবে জানা যায় যে, প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র সরবরাহকারী শামসুল হক শ্যামল ঢাকায় অবস্থান করছেন। পরে ঢাকার দক্ষিণ বাড্ডা থেকে শামসুল হক শ্যামলকে গ্রেফতার করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে প্রশ্নপত্রসহ উত্তরপত্র ফাঁস করার কথা স্বীকার করেন শামসুল হক শ্যামল। তার দেওয়া তথ্যে চক্রের মূল হোতা মুক্তারুজ্জামান রয়েলকে বাড্ডার আলিফনগর থেকে গ্রেফতার করা হয়। মুক্তারুজ্জামান আহছানউল্লা ইউনির্ভাসিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে আইসিটি টেকনিশিয়ান (হ্যার্ডওয়ার ও সফটওয়ার) হিসেবে কাজ করতেন। আহছানউুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অন্য সহযোগীদের সহায়তায় প্রশ্ন ও উত্তরপত্র সংগ্রহ করার কথা স্বীকার করেছেন তিনি।

গ্রেফতারদের দেওয়া তথ্য, মোবাইল ফোনে থাকা তথ্য এবং হোয়াটস অ্যাপ চ্যাটের তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর লালবাগ থেকে প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান মিলনকে গ্রেফতার করা হয়।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, পরীক্ষার আগে চক্রের সদস্যরা রাজধানীর বাড্ডা, বসুন্ধরা, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, রূপনগর, মিরপুর, মাতুয়াইল, শেওড়াপাড়া, শেরেবাংলা নগর, পল্লবী এলাকায় বুথ বসায়। এসব বুথে পরীক্ষার পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা আগে নিজস্ব লোকের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের ফাঁস করা প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করানো হয়। চক্রের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক বুথ থেকে ২০ থেকে ৩০ জন পরীক্ষার্থীকে উত্তর মুখস্থ করিয়ে কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে মুক্তারুজ্জামান ও শ্যামল জানান, এর আগে আরও তিনটি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁস করেছেন তারা। পরীক্ষার পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা আগেই বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে প্রায় ২ হাজার পরীক্ষার্থীর মাঝে তারা প্রশ্ন ও উত্তর সরবরাহ করেছেন। নিয়োগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর কাছ ৫ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। এমসিকিউ পরীক্ষার আগে ২০ শতাংশ, লিখিত পরীক্ষার আগে আরও ২০ শতাংশ ও নিয়োগ পাওয়ার পর বাকি ৬০ শতাংশ টাকা পরিশোধের শর্তে পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে চুক্তি হতো তাদের। চক্রটি এ পর্যন্ত ৬০ কোটি টাকা হাতিয়েছে।

ডিবি প্রধান বলেন, এ পর্যন্ত ১১টি বুথের তথ্য, চক্রের ২৫ থেকে ৩০ জন ও প্রায় ২০০ জন পরীক্ষার্থীর নাম পেয়েছি। মোক্তারুজ্জামান রয়েল প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁসের মূল হোতা। মোক্তারের কাছ থেকে প্রশ্ন নিয়ে শামসুল হক শ্যামল বিভিন্ন বুথে সরবরাহ করেন। জানে আলম ও মোস্তাফিজুর রহমান মিলন পরীক্ষার্থী সংগ্রহ ও বুথ নিয়ন্ত্রণ করেন এবং পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন ও উত্তর মুখস্থ করান। অর্থেও মাধ্যমে প্রশ্ন ও উত্তরও দেন তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে ডিবির এ কর্মকর্তা বলেন, এই প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ চক্রে আরও যারা জড়িত, তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করেছিল প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি, কিন্তু ডিবির অভিযানে প্রমাণিত হচ্ছে যে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল। এক্ষেত্রে এ নিয়োগ পরীক্ষাসহ আগের তিনটি নিয়োগ পরীক্ষা বাতিলের সুপারিশ করবে কি না- জানতে চাইলে হাফিজ আক্তার বলেন, আমরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রশ্নপত্র ফাঁসের তথ্য জানিয়েছি।

Tags: