muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

খেলার খবর

স্বপ্ন ছোঁয়া হয়নি বাংলাদেশের

বাংলাদেশ : ১৫ ওভারে ১২০/৭

ভারত : ১৩.৫ ওভারে ১২২/২

ফল : ভারত ৮ উইকেটে জয়ী

২০১২ আর ২০১৬ সালের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য একটাই।

আগেরবারের ফাইনাল শেষে অঝোরে কেঁদেছিল ক্রিকেটার থেকে শুরু করে পুরো দেশ। সেবার এই মিরপুরেই হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যাওয়া জয়ের স্বপ্ন পাকিস্তানের কাছে ২ রানের হারে বেরিয়ে যাওয়ার কষ্ট ছিল সীমাহীন। সে অর্থে কাল অন্তত কষ্টে পুড়তে দেননি শিখর ধাওয়ান-বিরাট কোহলিরা। যে দাপুটে ব্যাটিংয়ে টি-টোয়েন্টির সেরা দলটি ম্যাচ শেষ করেছে গতকাল, তাতে আর্তনাদ করার কোনো কারণ খুঁজে পায়নি মিরপুরের গ্যালারি। স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে ঠিকই, তবে অনভ্যস্ত ফরম্যাটে মাশরাফি বিন মর্তুজাদের বড় হয়ে ওঠার ইঙ্গিত পেয়েও স্বস্তির শীতল স্রোতই উসকে দেয়নি বেদনা।

ব্যাটিং পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে আবু হায়দার রনি এবং অর্ধেক ফিট সাকিব আল হাসানের করা পরের ওভারেই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে ভারত। ওই ২ ওভারে রানের যোগফল ২৯, তবে দুই দলের মনোবলের উত্থান-পতন বিবেচনায় ওভার দুটির মূল্যমান আরো বেশি। প্রথম ওভারেই আল আমিনের শিকারে পরিণত হন টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেলা রোহিত শর্মা। অন্য প্রান্তে তাসকিন আহমেদ যথারীতি ভারতের রানের চাকা ধরে রাখায় যে মৃদু আশা জেগেছিল তা ৫ ও ৬ নম্বর ওভারেই সব মুছে-টুছে শেষ। মহেন্দ্র সিং ধোনির ছক্কায় ভারত শিরোপা জয় নিশ্চিত হয়েছে ৭ বল আর ৮ উইকেট হাতে রেখে। তবু গ্যালারিভরা দর্শক রয়ে গেল সম্ভবত প্রিয় দলকে অভাবিত আনন্দের জন্য ধন্যবাদ জানাতেই। ধন্যবাদ মাশরাফিদের প্রাপ্যও।

ওয়ানডে মোড থেকে আরো স্বল্পদৈর্ঘ্যের টি-টোয়েন্টি বুঝতে অনেকটা সময় লেগেছে বাংলাদেশ দলের। খেলাটা বুঝলেও পুরোপুরি শিখে ফেলার দাবি এখনো করা হয় না বাংলাদেশ দলের পক্ষ থেকে। বরং এ ফরম্যাটে এখনো নিজেদের ছোট দল বলেই মনে করেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। অথচ ঝোড়ো বৃষ্টির কারণে কি না সেই ফাইনালও ‘অঙ্গহানি’র পর নেমে আসে ১৫ ওভারে। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না ড্রেসিংরুমের ড্রইংবোর্ডে শিষ্যদের সাফল্যের নতুন সূত্র দিয়ে থাকবেন কোচ চন্দিকা হাতুরাসিংহে। পোড় খাওয়া ভারতের অত ভয় নেই। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা টস জিতেই বোলিং এবং বাংলাদেশের বাঁ হাতি উদ্বোধনী জুটিকে আটকে রাখার জন্য রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে দিয়ে বোলিংয়ের শুরু—সবকিছু ভারতীয় অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির পছন্দমাফিকই হয়েছে। কিন্তু টি-টোয়েন্টির সুর বদলাতে সময় লাগে না বেশি। যেমন প্রথম ৫ বলে তামিমকে দোটানায় ফেলে দেওয়া অশ্বিনের শেষ বলটা কাভার দিয়ে সীমানার বাইরে পাঠাতেই গ্যালারির গর্জন—‘সৌম্য’, ‘সৌম্য’, শটটা যে সৌম্য সরকারের। পরের ওভারে আশীষ নেহরার বল স্কয়ার লেগ বাউন্ডারিতে তামিম ইকবালের ব্যাট হয়ে। এবার দ্বিগুণ ডেসিবলে ফাটল গ্যালারি। তামিম তো আর এমনি এমনি বলেন না যে মাত্র দুটা ওভারেই রং বদলে ফেলে টি-টোয়েন্টি। কাল শুরুর রংটা তো বদলালো মাত্র ২ বলে! অবশ্য ২ ওভারে ১১ রানে রং বদলের ছবি নেই, তবে ব্যাকফুট থেকে ফ্রন্টফুটে এগোনোর আত্মবিশ্বাস তো রয়েছে। অদ্ভুত বোলিং অ্যাকশনে নিয়মিত উইকেট তুলে নেওয়া জসপ্রীত বুমরাহর প্রথম ওভারটা নিরাপদে খেলে দেওয়া সে আত্মবিশ্বাসে ভর করেই। ক্রিকেটে বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে ঘটতে থাকে, ঘটেছে কালও। চতুর্থ ওভারে নেহরাকে মিড অফ ফিল্ডারের মাথার ওপর দিয়ে তামিমের তুলে দেওয়া কিংবা সৌম্যর ড্রাইভ আর পুলে জোড়া বাউন্ডারিতে ‘বিশ্রাম’ই পাচ্ছিল না উত্তাল গ্যালারি। অবশ্য সে ওভারেই সৌম্য মিড অফে ক্যাচ দিয়ে ফেরার পথে প্রত্যাশিত নীরবতা গ্যালারিতে।

৪ ওভারে ১ উইকেটে ২৭ যখন, তখন ধরেই নেওয়া যায় বাংলাদেশ ইনিংসে উত্তাল হওয়ার আরো উপলক্ষ পাবে দর্শক। পরের ওভারে তামিমকে বুমরা তুলে নেওয়ার পর মনে হচ্ছিল, এই যা! কিন্তু টি-টোয়েন্টি মানেই নিরবচ্ছিন্ন উত্তেজনা, সদ্যই উইকেট পাওয়া বোলারের হাসি মুছতে না মুছতেই বল ছোটে বাউন্ডারিতে। ফর্মের তুঙ্গে থাকা সাব্বির রহমান আর সাকিবের মধ্যকার তৃতীয় উইকেট জুটি যেমন ভারতীয় বোলারদের শাসিয়ে বিনোদন বিলিয়ে গেছেন গ্যালারিতে। খাটো লেন্থের বোলিংয়ের জন্য ক্ষুদ্র ক্যারিয়ারেই বিস্তর সুনাম কুড়িয়েছেন ভারতের হার্দিক পান্ডে। কিন্তু তিনি তো আর জানতেন না যে গত কদিন নেটে টানা পুল প্র্যাকটিস করেছেন সাকিব। প্র্যাকটিসের আংশিক ফললাভও হয়েছে বাঁ হাতি অলরাউন্ডারের, পান্ডেকে পাঠিয়েছেন মিড উইকেট বাউন্ডারিতে। তার আগে রবীন্দ্র জাদেজার ওপর চড়াও হয়েছিলেন সাকিবের সঙ্গে সাব্বিরও। তাই ভারতের বাঁ হাতি স্পিনারটি নিজের প্রথম ওভারেই গুনেছেন ১২ রান। তাতে পুরোটা ইনিংসজুড়েই বাংলাদেশের ব্যাটিংকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে গেলেন ভারতীয় অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। ৫ ওভারের ব্যাটিং পাওয়ার প্লে শেষ হতেই যে ফিল্ড নিয়ে তিনি খেলেছেন, তাতে মনে হতে পারে বুঝি ওয়ানডের স্লগ ওভার চলছে আর বাংলাদেশ ৩ উইকেটে ২৪০ এর ওপরে! চার-ছক্কার ফুলকি ছোটাতে না পারলেও ‘মোরাল ভিক্টোরি’ তো হয়েছিল বাংলাদেশের!

বাংলাদেশ ইনিংসের মূল সুরটা অবশ্য টসের মতোই ভারতীয়। সাব্বিরের সঙ্গে ৩৪ রানের জুটি গড়ে সাকিবের বিদায়ের পর মুশফিকুর রহিমের আরেকবার রান আউট বিপাকে ফেলে বাংলাদেশকে। তখন স্পিন আক্রমণে দেখে রানের ঘোড়া ছোটানোর জন্য ছয় নম্বরে নেমেছিলেন মাশরাফি নিজেই। তুলেও মেরেছিলেন প্রথম বলটাই, কিন্তু সেটি গিয়ে জমা পড়ে ডিপ মিড উইকেট ফিল্ডারের হাতে। দ্বাদশ ওভারে দলীয় ৭৫ রানে মাশরাফিকে ফিরে যেতে দেখে প্রথমবারের মতো পিনপতন নিস্তব্দতা গতকালের গ্যালারিতে। সেই গ্যালারিও সরব থেকেছে বাংলাদেশ ইনিংসের শেষভাগে, সাব্বির ও মাহমুদ উল্লাহর সৌজন্যে। নেহরাকে স্কুপ করে সাব্বিরের আরেকটি বাউন্ডারি কিংবা মাহমুদের অফ ড্রাইভের নিখাদ ব্যাটসম্যানশিপের সৌন্দর্য তো মাতাবেই দর্শকদের। পরের ওভারে পান্ডের ওপর যেন প্রথম ম্যাচের প্রতিশোধই নিলেন মাহমুদ উল্লাহ। দুই বাউন্ডারি আর এক ছক্কাসহ তিনি ১৬ রান তুলে ফেলার পর ধোনিকে বাধ্য হয়েই যেতে হয় বোলারের কাছে। সবমিলিয়ে ওই ওভারে ২১ রান দিয়েছেন পান্ডে। বড় ক্যানভাসে সেটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় মোরাল ভিক্টোরি। তৃতীয়টা অবশ্যই মাহমুদ উল্লাহর ঝড়। লোয়ার অর্ডারে তুলে মারতে পারে না বাংলাদেশের কেউ, তাঁর ১৩ বলে ৩৩ রানের ইনিংসে রয়েছে সে অপবাদ ঘোচার জোরালো ইঙ্গিত। সেই ২০০৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ৫ বলে ১৩ রান করেই বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে ‘দ্রুতগামী’ ইনিংসের মালিক হয়ে ছিলেন মোহাম্মদ রফিক (স্ট্রাইকরেট ২৬০)। কাল মাহমুদ উল্লাহ (২৫৩.৮৪) দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে দুই শর বেশি স্ট্রাইকরেটের মালিক হয়েছেন। ওদিকে ২৮ বলে ৩১ রানে অপরাজিত থাকা সাব্বিরের ইনিংসে ফর্মের সৌরভ, একাধারে টপ-অর্ডারের কারো শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার সুফলও হাতে-কলমে বুঝিয়ে দিল বাংলাদেশকে। ভারতের বিপক্ষে ১৫ ওভারে ১২০ রান তো মাশরাফিদের জন্য সুফলাই!

ফাইনালের উইকেটটাকে মাঝখানে রেখে দুই প্রান্তে দুই দল যখন ফুটবল খেলে গা ঘামানোয় ব্যস্ত তখন ফিজিওকে নিয়ে আলাদা সাকিব আল হাসান। ৪৮ ঘণ্টা আগে বলের আঘাতে উরুর পেশিতে পাওয়া চোটের ধকল তাঁর নড়াচড়ায় স্পষ্ট। চোট কতটা গুরুতর সেটি নিশ্চিত হতেই ফিজিও বায়েজিদুল ইসলামের কাছে পরীক্ষা দিচ্ছিলেন সাকিব। দৌড় এবং বারকয়েক হাত ঘোরানোর পর দলের কাছে সাকিবের খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফেরার দৃশ্যটা ঘণ্টা তিনেক আগের ঝোড়ো বৃষ্টির চেয়েও ভীতিকর, খেলতে পারবেন তো তিনি! অবশ্য কিছু সময় পর টসের সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া খেলোয়াড় তালিকা দেখে সে গুমোট হাওয়া কেটেও গেছে। আগের রাতে সতীর্থদের বলা ‘এবার কাপটা রাখতে হবে’ তো আর এমনি এমনি বলেননি সাকিব। ব্যথা অস্বীকার করেও নেমে পড়েছেন ফাইনাল যুদ্ধে। কিন্তু ২ ওভারে ২৬ রান দেওয়ায় আর মহানায়ক হতে পারেননি সাকিব।

স্বপ্ন ছোঁয়া হয়নি বাংলাদেশেরও। আনুষ্ঠানিক পুরস্কার বিতরণীতে যথারীতি জয়জয়কার ভারতের, আবেগটাকে দূরে সরিয়ে রাখলে যা অভাবিতও নয়। আর অচেনা ফরম্যাটে শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানকে টপকে ফাইনালে ওঠা যেমন অভাবিত কৃতিত্বের তেমনি ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ক্রিকেট মানেও রয়েছে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। সাব্বির রহমানের টপ-অর্ডারে সেট হয়ে যাওয়া, আল আমিনের উইকেট নেওয়ার অভ্যাস, তাসকিনের আঁটসাঁট বোলিং এবং সবশেষ ব্যাটসম্যানশিপ দিয়ে টি-টোয়েন্টিতে মাহমুদ উল্লাহর নিজের জায়গা পাকা করা প্রাপ্তির তালিকাটা কম দীর্ঘ নয়। কাপের বিনিময়ে এ-ও তো কম পাওনা নয়!

মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ ডটকম/07-03-2016/মইনল হোসেন

Tags: