বাংলাদেশের রাজনীতিতে সততা নিষ্ঠা আদর্শের উজ্জ্বলতার প্রতিচ্ছবি ‘বিউটি অব পলিটিকস’ হিসেবে খ্যাত সৈয়দ আশরাফের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি ৬৮ বছর বয়সে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
বাংলার স্বাধীনতার অন্যতম সংগঠক, যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের জৈষ্ঠপুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বছরের প্রথম দিনে ময়মনসিংহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
বাবা সৈয়দ নজরুলের রাজনৈতিক পদচারণ দেখতে দেখতেই রাজনীতির হাতে খড়ি হয় সৈয়দ আশরাফের। তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া তিনি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-প্রচার সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তরুণ টকবগে সৈয়দ আশরাফ দেশের জন্য অস্ত্র তুলে নেন। তিনি মুক্তিবাহিনীর একজন সদস্য ছিলেন। ভারতের দেরাদুনে প্রশিক্ষণ নেন তিনি।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারে জাতীয় চার নেতার সঙ্গে পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর যুক্তরাজ্য চলে যান সৈয়দ আশরাফ। প্রবাস জীবনে তিনি যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
আশরাফুল ইসলাম ১৯৯৬ সালে দেশে ফিরে আসেন এবং কিশোরগঞ্জ সদর আসন থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় তিনি নির্বাচিত হন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালের ১৬ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন।
ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দ আশরাফুল ব্রিটিশ ভারতীয় শীলা ঠাকুরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শীলা লন্ডনে শিক্ষকতা করতেন এবং ২৩ অক্টোবর ২০১৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের একটি মেয়ে রয়েছে (রীমা ঠাকুর), যে লন্ডনের এইচএসবিসি ব্যাংকে চাকরি করেন।
এক-এগারোতে সেনা সমর্থিত সরকার রাজনীতি থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার নীল-নকশা নিয়ে যখন এগোচ্ছিল তখনও যুক্তরাজ্যে ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। বয়সের ভারে ন্যূব্জ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমান একা সব কিছু সামাল দিয়ে পেরে উঠছিলেন না। সেই ক্রান্তিলগ্নে লন্ডন থেকে দেশে ফিরেন সৈয়দ আশরাফ।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল কারাগারে থাকায় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন ‘মিস্টার ক্রাইসিস ম্যান’ খ্যাত সৈয়দ আশরাফ। দৃঢ়চিত্ত আর রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে উদ্ধার করে শেখ হাসিনাকে মুক্ত ও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনে আবারও তাঁর প্রত্যাবর্তনকে অবিস্মরণীয় করে রাখেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
কিশোরগঞ্জ সদর আসনের টানা পাঁচবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের দুই বারের সাবেক সফল সাধারণ সম্পাদক, সাবেক এলজিআরডি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নেই আজ তিন বছর। এই তিন বছরে রাজনৈতিকভাবে যেমনি অভিভাবকশূণ্য হয়ে পড়েছে কিশোরগঞ্জ, তেমনি বাংলাদেশ অনুভব করছে বিরল এই রাজনীতিকের শূণ্যতাকে।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুতে আজো কাঁদে কিশোরগঞ্জ, কাঁদে বাংলাদেশ। তিন বছর পর এসেও তাঁর জনপ্রিয়তায় এতটুকুও ভাটা পড়েনি। আওয়ামী লীগের চরম বিরুদ্ধবাদীরাও বলছেন, এ এক অপূরণীয় মৃত্যু।
দলের ভেতরে-বাইরে জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয় এমন রাজনীতিবিদ কোন দলেই সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি। সৈয়দ আশরাফের এই কারিশমার রহস্য আজো অজানাই রয়ে গেছে, যা তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। শারীরিক মৃত্যু সেখানে একেবারেই তুচ্ছ।
কিশোরগঞ্জের আধুনিকায়নে আশরাফের ভাবনা ছিল অসাধারণ। শহরের প্রাণপ্রবাহ নরসুন্দার নাব্য ফিরে পেতে তার আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। এ জন্য উদ্যোগও নিয়েছিলেন। শহরের উন্নয়ন, সৌন্দর্যবর্ধন ও আধুনিকায়নে একটি মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু কূটিল-জটিল রাজনীতি ও সীমাহীন লোভ-লালসার অন্তরালে অধিকাংশ আশাই তার পূরণ হয়নি।
তিনি কিশোরগঞ্জে গড়ে তুলেছেন শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। যেমনটি তার বাবা শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীনতার পর একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ে কিশোরগঞ্জ টেক্সটাইল মিল প্রতিষ্ঠা করে হাজারো শ্রমজীবীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন। একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্নপূরণের আগেই তাকে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিতে হয়েছে।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী কিশোরগঞ্জে গভীর শোক ও শ্রদ্ধাভরে পালন করা হচ্ছে। এ উপলক্ষে সকালে জেলা শহরের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম চত্বরে স্থাপিত সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ম্যুরালে জেলা আওয়ামী লীগ, অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
এসময় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান শাহজাহান, সাধারণ সম্পাদক এম এ আফজল, জেলা কৃষক লীগের সভাপতি আহমেদ উল্লাহ, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মো. পারভেজ মিয়া, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আনোয়ার কামাল, কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিলকিছ বেগম, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শরীফুল ইসলাম, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন, সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ ওমান খান, সাংগঠনিক সম্পাদক লুৎফুর রহমান নয়ন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিকালে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এক আলোচনা সভা ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া পারিবারিকভাবে গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলার যশোদল ইউনিয়নের বীরদামপাড়ায় মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।