মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ ডেস্কঃ- সামন্ত যুগে শক্তিশালীরা বল প্রয়োগ করে অন্যদের পরিচালনা করত। শক্তির পরীক্ষায় মূলমন্ত্র ছিল প্রতিপক্ষকে খুন করা। নেতা নির্বাচনের এই অসভ্য প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে প্রথমবারের মতো নির্বাচনের মাধ্যমে জনমত নিয়ে নেতা বাছাই শুরু করে প্রাচীন গ্রিস। তখন রোমে পোপ নির্বাচনপ্রক্রিয়াও হতে থাকে জনমতের ভিত্তিতে।
সেই থেকে সভ্যতার প্রতীক হিসেবে, গণতন্ত্রের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে নির্বাচন। তবে বাংলাদেশে নির্বাচন মানেই প্রাণক্ষয়, আধিপত্য বিস্তার আর শক্তির মহড়া। অস্ত্র প্রয়োগ, প্রতিপক্ষকে যেকোনো কায়দায় ঘায়েল করে জয় ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা এখনো স্পষ্ট। গত মঙ্গলবার ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের প্রথম ধাপে ১১ জনের প্রাণহানির ঘটনাও এ কারণেই। ইউপির মতো ছোট পরিসরের নির্বাচনে, যেখানে ভোটাররা পরস্পরকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন, জানেন—এমন পরিবেশে এত প্রাণহানির ঘটনা অনেককেই বিস্মিত করেছে।
নির্বাচন কমিশনের পরিপত্র অনুযায়ী, ইউপি চেয়ারম্যান পদে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা খরচ করতে পারবেন। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাস্তবে খরচ হয় ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত। কোনো কোনো প্রার্থীকে মনোনয়ন পাওয়ার জন্যই আগে থেকে ব্যয় করতে হয়েছে এর চেয়ে বেশি অর্থ। আর মনোনয়ন পেতে অর্থ বিনিয়োগ এবং নির্বাচনে বিপুল ব্যয় করার পর জনসেবার বদলে তাঁদের মূল নজর থাকে অর্থ লুটে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সাধারণত পাঁচ-সাতটি গ্রাম কিংবা সর্বোচ্চ হাজার বিশেক ভোটারের একটি ইউনিয়নের বার্ষিক বাজেটে সরকারের সরাসরি অর্থায়ন বেশ কম। কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা), টেস্ট রিলিফ (টিআর), ভূমি রেজিস্ট্রেশন কমিশন, স্থানীয় সরকারের রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কার কাজ মিলিয়ে একটি ইউনিয়নের বছরে মোট আয় কোটি টাকার মতো। সেখান থেকে সংসদ সদস্যের কমিশন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অর্থ ব্যয় মেটানোর পর বছরে বড়জোর ৫০ লাখ টাকা পকেটে ভরতে পারেন দুর্নীতিগ্রস্ত কোনো ইউপি চেয়ারম্যান। তাতে পুরো মেয়াদকালে বড়জোর আড়াই কোটি টাকা হয় তাঁর। তবে কেবল এই টাকা পকেটে ভরার জন্যই যেকোনো মূল্যে জয়ী হওয়ার প্রবণতা কাজ করে না, বরং চেয়ারম্যানের চেয়ারের গুণে এলাকায় চাঁদাবাজি, ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, গ্রাম্য সালিসের নামে অর্থ আদায়, প্রভাব-প্রতিপত্তি—এগুলোর মোহই যেকোনো মূল্যে জয়ী হওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি করছে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী, সমর্থক কিংবা প্রভাবশালী বিদ্রোহীদের মধ্যে। ফলে সরকারি অফিস পরিচালনা বা ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনের যে সভ্য প্রক্রিয়া প্রাচীন গ্রিসে শুরু হয়েছিল, বাংলাদেশে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির লোভ তাকে পেছনে টেনে ধরছে। দলীয় ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়নও এই সহিংসতার বড় কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দীর্ঘদিন ধরে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ওসমানগঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন আব্দুল মান্নান। তিনি জানান, ইউপির একজন দুর্নীতিগ্রস্ত চেয়ারম্যান বছরে খুব বেশি হলে কোটি টাকার মতো পান নানা উৎস থেকে। কাজের নামে সামান্য ব্যয় করে, চৌকিদারদের বেতন দিয়ে, এমপিকে কমিশন দিয়ে আর মেম্বারদের অল্প কিছু ভাগ দিয়ে বছরে বড়জোর ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার মতো চেয়ারম্যান আত্মসাৎ করতে পারেন। তবে চেয়ারম্যান হতে পারলে টাকা কামানোর আরো উৎস খুলে যায়। ইউনিয়ন পরিষদসহ ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন অফিসে নিয়োগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ, উপজেলা পরিষদের কাজের ঠিকাদারি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, গ্রাম্য সালিসের নামে চাঁদাবাজিসহ নানাভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করতে পারেন দুর্নীতিগ্রস্ত চেয়ারম্যানরা। এসব লোভ ও প্রভাবের মোহে ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকরা জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সাধারণত বড় একটি গ্রাম নিয়েই একটি ওয়ার্ড গড়ে উঠছে। আবার পাশাপাশি ছোট দুই গ্রাম নিয়ে একটি ওয়ার্ডও রয়েছে। প্রতি ওয়ার্ডে একটি করে কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে ভোটাররা একজন মেম্বার প্রার্থী, সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী সদস্য ও একজন চেয়ারম্যান প্রার্থীকে ভোট দেন। একটি কেন্দ্রে ভোট দিতে যাওয়া কিংবা প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকরা বছরের পর বছর বংশগতভাবে একই স্থানের বাসিন্দা। কৃষি জমিতে, হাট-বাজারে, মসজিদ-মন্দিরে কিংবা রাস্তাঘাটে প্রতিনিয়ত দেখা হয় তাদের, হয় কুশলবিনিময়। একে অপরের ঘনিষ্ঠ সেই ভোটার-কর্মী-সমর্থকরা এবার ইউপি নির্বাচনে প্রাণখেকোর ভূমিকায় নেমেছে। বেশির ভাগ কেন্দ্রে সেটা হয়েছে ভোটের পরে, যেকোনো মূল্যে ফল নিজের প্রার্থীর পক্ষে নেওয়ার চেষ্টায়। গ্রামের সাধারণ ভোটাররা পুলিশের বাঁশির শব্দেই দৌড়ে পালান, অথচ সেখানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের তাক করা বন্দুক দেখেও পালানো দূরের কথা, তাদের অবরুদ্ধ করে জয়ের ঘোষণা পেতে গিয়েই পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় প্রাণ গেছে পাঁচজনের। নিহত অন্য ছয়জনের মধ্যেও তিনজন মারা গেছেন ভোটগ্রহণের পরের সহিংসতায়, কোথাও প্রার্থীর পক্ষে ফল ছিনিয়ে নিতে গিয়ে, কোথাও নির্বাচনী প্রচারণাকালীন ঘটনার প্রতিশোধ নিতে।
চেনা-জানা মানুষদের এমন সহিংস হয়ে ওঠার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নির্বাহী সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দলীয়ভাবে শুরুর মধ্য দিয়ে ইউপি নির্বাচন একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। এখানে গ্রামবাসীর বদলে কে কোন দল করে সেটিই মুখ্য হয়ে উঠেছে। অতীতে এসব নির্বাচনে দলীয় প্রভাব থাকলেও তা প্রকাশ্যরূপ পেত না। এখন আর সে পরিবেশ নেই। তিনি বলেন, সামন্ত যুগে ক্ষমতাবানরাই সব কিছু শাসন করত। সভ্য জগতে ক্ষমতাবদলের প্রক্রিয়া হিসেবে নির্বাচনের প্রচলন হয়। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচনে যেভাবে প্রাণহানি ঘটছে, তাতে মনে হচ্ছে আমরা সেই পুরনো যুগেই ফিরছি। দলীয়ভাবে ইউপি নির্বাচন আয়োজনের ফলে মনোনয়ন-বাণিজ্য তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মনোনয়ন নিয়েই প্রভাবশালীদের মধ্যে সহিংসতা শুরু হয়েছে। তখন থেকেই মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা, হুমকির পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছিল। তখনই বোঝা যাচ্ছিল, নির্বাচন ঘনালে সহিংসতা আরো বাড়বে। এসবের পরিণতি অশুভ। পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াই ভেঙে পড়ে।
বাংলাদেশে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো লক্ষণ দেখছেন না সুজন সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘আমি উত্তরণের কোনো পথ দেখছি না। যাদের দায়িত্ব নেওয়ার কথা, তারা দায়িত্ব নিচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন শপথ নিয়েছে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করার; কিন্তু তারা বলছে সহিংসতার দায় নেবে না। নির্বাচন কমিশন যখন অসহায়ত্ব স্বীকার করে বলে যে নির্বাচনে টাকার খেলা হচ্ছে, সেখানে তো আর কিছুই বলার থাকে না।’
বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একাংশের কার্যকরী সভাপতি মঈন উদ্দীন খান বাদল বলেন, ‘আমি মনে করি, দেশে এখনই দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনের সময় আসেনি। দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের প্রয়োজনও হয়নি। আমাদের মনের মধ্যে এক ধরনের আধিপত্যবাদ তৈরি হয়েছে, যেখানে বিরোধী কোনো মতকে রাখতে চাই না; যার প্রতিফলন দেখা গেছে ইউপি নির্বাচনের প্রথম ধাপে।’ তিনি বলেন, ‘গ্রামাঞ্চলে আগে ইউপি নির্বাচনে সহিংসতা তেমন দেখা যেত না। এবারের নির্বাচনে সহিংসতার মাত্রা বেড়েছে বহুগুণ। দেশে কোনো বিরোধী পক্ষ না রাখার যে মানসিকতা আমাদের মাঝে তৈরি হয়েছে সে জন্য এ জাতিকে একদিন এর কঠিন মূল্য দিতে হবে।’
মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ ডটকম/24-03-2016/মইনুল হোসেন