muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

জাতীয়

জিয়াউর রহমানের কবর সরিয়ে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত সরকরের

মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ ডেস্কঃ- জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা থেকে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর সরিয়ে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বেশ কয়েকবার বিষয়টি আলোচনায় আসলেও নানান আইনি জটিলতায় এতদিন আটকে ছিলো প্রক্রিয়াটি।

এবার সব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে । জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার উত্তর পাশে চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে সরিয়ে এ কবর মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সেক্টর কমান্ডারদের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে মন্ত্রনালয় সুত্র । বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের মূল নকশায় জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় কবরস্থানের জন্য কোনো জায়গা রাখা হয়নি- এই যুক্তিতে জিয়াউর রহমানের কবর সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে জানানো হয়েছে , সংসদ ভবন এলাকার মূল নকশা আনতে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র যাবে। সে প্রক্রিয়ায় আগামী জুনের মাঝামাঝি সময়ে হাতে আসবে নকশার অনুলিপি। সেটি হাতে এলেই কবরসহ সংসদ এলাকার নকশার বাইরের স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার চূড়ান্ত উদ্যোগ নেবে মন্ত্রণালয়।

এছাড়াও সংসদ ভবনের দক্ষিণ চত্বরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় অবস্থিত জাতীয় কবরস্থানের সাতটি কবরও সরিয়ে নেয়া হবে। তবে সেখান থেকে সব কবর মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে যাবে না। বিতর্কিত ব্যক্তিদের কবর অন্যত্র সরানো হবে। এদের কবর নিজ নিজ পারিবারিক কবরস্থানে বা কোনো সরকারি কবরস্থানে সরিয়ে নেয়া হবে। এর আগে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল লুই আই কানের নকশা আনতে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র যাবে।

এই বিষয়টি নিশ্চিত করে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন একটি জাতীয় দৈনিককে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘কবরস্থানের জায়গায় কবর হবে এটাই নিয়ম। জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় কবর হবে কেন? তাছাড়া লুই আই কানের নকশার কোথাও শেরেবাংলা নগরে কবরস্থানের জন্য জায়গা নির্ধারিত ছিল না।’ মন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমি মনে করি সংসদ এলাকা থেকে কবর ছাড়াও নকশাবহির্ভূত সব স্থাপনা সরানো উচিত। জাতীয় প্রয়োজনে মসজিদ-মাদ্রাসাও তো সরানো হয়।’ তিনি বলেন, ‘আইয়ুব খান সংসদ ভবনকে ঘিরে শেরেবাংলা নগরজুড়ে সেকেন্ড ক্যাপিটাল গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সেভাবেই লুই আই কানের ডিটেইল নকশা প্রণীত হয়েছে। আমরা সে নকশাটাই কেবল প্রতিস্থাপন করতে চাইছি।’ মন্ত্রী বলেন, ‘ইতিমধ্যে মূল নকশা আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নকশা আনার পর সে অনুযায়ী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’

জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার উত্তর পাশে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের কবর ছাড়াও সংসদ ভবনের দক্ষিণ চত্বরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় প্রায় পাঁচ বিঘার জায়গার ওপর অবস্থিত জাতীয় কবরস্থানে আরও সাতজনের কবর রয়েছে। তারা হলেন- সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ও আতাউর রহমান খান, সাবেক মন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়া, মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার তমিজউদ্দীন খান। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে এই সাতজনকে এখানে কবর দেয়া হয়।

পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ সালে মার্কিন স্থপতি লুই আই কানের নকশা অনুযায়ী সংসদ ভবন কমপ্লেক্সটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে কমপ্লেক্সটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৮২ সালে। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমানের কবরকে কেন্দ্র করে চন্দ্রিমা উদ্যানের নাম পরিবর্তন করে জিয়া উদ্যান করে এবং এখানে সুদৃশ্য একটি সমাধি সৌধ নির্মাণ করে। এছাড়াও কবরের কাছে যাওয়ার জন্য স্থাপন করে একটি আকর্ষণীয় বেইলি ব্রিজ। তবে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ জিয়া উদ্যানকে ফিরিয়ে দেয় তার আগের পরিচয় ‘চন্দ্রিমা উদ্যান’-এ। ক্রিসেন্ট লেকের ওপর থেকে বেইলি ব্রিজটিও সরিয়ে দেয়া হয়। পরে আবার বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেখানে কংক্রিটের ঝুলন্ত সেতু নির্মাণসহ একটি কমপ্লেক্স গড়ে তোলে। কমপ্লেক্সটির চারদিকে থাকা চারটি প্রবেশপথের শুরু বা শেষ প্রান্তে রয়েছে ঝুলন্ত সেতু, সম্মেলন কেন্দ্র ও মসজিদসহ চারটি স্থাপনা।

জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১৭ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় জিয়াউর রহমানের কবর চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বছরেরই ৭ জুলাই একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সংসদ ভবনের ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি লুই আই কানের নকশা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কবরগুলো যদি সরানোর দরকার হয়, তাহলে সরকার তা করবে। এরপর এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব তৈরি করে ১৪ জুলাই গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে স্থপতি লুই আই কানের নকশায় শেরেবাংলা নগর এলাকায় কবরস্থানের জন্য কোনো জায়গা রাখা হয়নি উল্লেখ করে জিয়াউর রহমানের কবরসহ জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় অবস্থিত সব ক’টি কবর সরানোর পক্ষে মত দেয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

সূত্র জানায়, এরপর থেকেই সংশ্লিষ্ট মহলে এ পরিকল্পনা কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে সংসদ ভবন এলাকা থেকে জিয়াউর রহমানের কবর সরিয়ে তার জন্মস্থান বগুড়া জেলার বাগবাড়ীর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে নানা দিক বিবেচনা করে সরকার মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সেক্টর কমান্ডারদের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের আরেক সেক্টর কমান্ডার হিসেবে জিয়াউর রহমানের কবর সেখানে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অবশিষ্ট সাতজনের কবরও সুবিধাজনক জায়গায় সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে তারা বিতর্ক এড়াতে এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার আর্কাইভসে সংরক্ষিত লুই আই কানের মূল নকশার অনুলিপি আনার জন্য অপেক্ষায় থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।

জানা গেছে, জাতীয় সংসদ সচিবালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং স্থাপত্য অধিদফতর যৌথ উদ্যোগে নকশা আনার প্রক্রিয়া শুরু করে। ২৯ মার্চ স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত হয় ত্রিপক্ষীয় বৈঠক।

এ বৈঠকে জানানো হয়, পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার আর্কাইভসে লুই আই কানের প্রায় ৮ হাজার নকশা রয়েছে। এর মধ্যে ৮৫৩টি নকশা গুরুত্বপূর্ণ। বৈঠকে এই ৮৫৩টি নকশাই সংগ্রহ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলকে আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র পাঠানোরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এ বৈঠকে। প্রতিনিধি দলে থাকবেন স্থাপত্য অধিদফতর থেকে দু’জন, গণপূর্ত অধিদফতর থেকে একজন, পিডব্লিউডি থেকে একজন এবং সংসদ সচিবালয় থেকে একজন। বৈঠকে জানানো হয়, প্রতি নকশার জন্য ১৯ ডলার খরচ হবে। এছাড়া ১১৫টি নকশা আছে যেগুলো আনবিল্ড (এখনও কোনো ভবন হয়নি), ওই আনবিল্ড নকশার জন্য খরচ হবে আরও ৬০ হাজার ডলার। এছাড়াও ইতিমধ্যে নকশা সার্চ করতে ৩ হাজার ৫৫০ মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়েছে।

বৈঠকে জানানো হয়, লুই আই কানের নকশা প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত একজন স্থপতি এখনও বেঁচে রয়েছেন, যার বয়স ৮৭ বছর। প্রতিনিধি দল তার সঙ্গেও দেখা করবে। এজন্য প্রতিনিধি দলকে ওই স্থপতির সঙ্গে আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে বলা হয়েছে। সেখান থেকে প্রতিনিধি দল নকশাগুলো দেখে অনুমোদন দেয়ার পর টাকা দেয়া হবে। তাতেও ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে জুনের মাঝামাঝি সময়ে হাতে আসবে নকশার অনুলিপি। এর পরপরই গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কবরসহ নকশাবহির্ভূত স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার চূড়ান্ত উদ্যোগ নেবে।

প্রসঙ্গত, এর আগে সংসদ ভবন এলাকা থেকে জিয়াউর রহমানের কবর সরানো হবে এমন সংবাদ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে প্রতিহত করার ঘোষণা দেওয়া হয় ।বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান হুঁশিয়ারি দিয়ে সেসময় বলেন, তার দলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধি সরানোর চক্রান্ত ‘জনগণ রুখে দেবে।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার যেভাবে গণতন্ত্র নির্বাসনে দিয়েছে, একইভাবে সংসদ এলাকার জিয়া উদ্যান (চন্দ্রিমা উদ্যান) থেকে জিয়াউর রহমানের মাজার সরানোরও ষড়যন্ত্র করছে। আহমেদ আজম খান বলেন, সরকার এখন বেসামাল হয়ে গেছে, কী করবে, কী বলবে ঠিক পাচ্ছে না। সরকার জিয়ার মাজার সরিয়ে কোথায় নিয়ে যেতে চায়? সরকার গণতন্ত্রকে যেভাবে নির্বাসনে দিয়েছে মহানায়ককেও (জিয়া) সেইভাবে নির্বাসনে পাঠাতে চায়।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতা ছাড়ার আতঙ্কে ভুগছে। এ আতঙ্ক থেকে বের হয়ে এসে জাতীয় সংলাপের আয়োজন করতে হবে।
ক্ষমতাসীনরা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার সমাধি সরানোর চেষ্টা করলে তা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করা হবে বলে সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন বিএনপির ততকালিন ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (বীর বিক্রম)। হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, শহীদ জিয়ার দৃষ্টি নন্দন এ সমাধিটি জনগণের হৃদয়ে স্থান দখল করে আছে। তাই এই মাজার সরানোর মতো দুঃসাহস দেখাবেন না। যদি করেন তাহলে সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিহত করা হবে।

মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ ডটকম/04-04-2016/মইনুল হোসেন

Tags: