১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় গোর্কির আঘাতে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল। ফসলহানী ও ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছিল দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। কিন্তু পাকিস্তান সরকার সে সময় দ্রুত পর্যাপ্ত সাহায্য নিশ্চিত করতে পারেনি। ঠিক এর এক বছর পরেই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের নামে এদেশের নিরীহ মানুষের উপর পাক আর্মি আক্রমণ করে গণহত্যা চালায়।
দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা লাভের পর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধকালীন ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে না উঠতেই টানা দুই বছর আউশ ও আমন ধানের উৎপাদন ব্যাহত হয়। ১৯৭৩ সালে প্রথম অনাবৃষ্টিতে এবং ১৯৭৪ সালে বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফলে দেশে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। আর ১৯৭৩ সালের বিশ্বব্যাপী তেলসংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং আর্থিক মন্দার মুখে যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশেও বৈদেশিক মুদ্রায় ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে সরকারের পক্ষে খাদ্য আমদানি করাও কঠিন হয়ে পড়ে। তবুও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে বছর ৭৩২ কোটি টাকার খাদ্যশস্য আমদানি করেছিল। কিন্তু মধ্যসত্ত্বভোগী, দালাল, মজুতদার এবং দুর্নীতিবাজদের কারণে দেশ কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়।
ফলে ১৯৭৪ সালের মার্চ থেকে বছরের শেষ পর্যন্ত সময়কালে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এতে বহু মানুষ মারা যায়। অনেকে তাদের ভিটেমাটি ও সর্বস্ব বিক্রি করে খাদ্যের সন্ধানে শহরে পাড়ি জমায়। পরিস্থিতি মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি সাহায্য করতে বিলম্ব করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সে সময়ের সরকার সাহায্য চেয়েও পায়নি। বাংলাদেশ ও কিউবার বাণিজ্য সম্পর্ক থাকার অযুহাতে সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য দেয়া বন্ধ করে দেয় হেনরি কিসিঞ্জার।
তখন যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার সম্পর্ক ছিল চরম শত্রুতাপূর্ণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও কিউবা সমর্থন জানিয়েছিল এবং যুক্তরাষ্ট্র বিরোধিতা করেছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দ্রুতই কিউবা দেশকে স্বীকৃতিও দিয়েছিল। কিউবার সাথে ১৯৭২ সালেই কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পর বাংলাদেশ জুট কর্পোরেশন মাত্র একবারের জন্য ৫০ লাখ ডলারের বিনিময়ে ৪০ লাখ চটের ব্যাগ বিক্রি করেছিল কিউবার কাছে। কিন্তু কোন বাণিজ্য চুক্তি করেনি বাংলাদেশ। তবুও কিউবার সাথে বাণিজ্য করার অযুহাতে সাহায্য বাতিল করেছিল আমেরিকা। ফলে দেশে দুর্ভিক্ষ চরম আকার ধারণ করে।
স্বাধীনতার মাত্র ২ বছর যেতে না যেতেই বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের মার্চে শুরু হওয়া দুর্ভিক্ষ সে বছরেরই ডিসেম্বরের দিকে গিয়ে শেষ হয়। এই দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। সরকারী হিসেব অনুসারে ৩০ হাজার মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। বেসরকারি হিসেবে অনুমানিক ১ লক্ষ থেকে ৪ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মৃত্যুবরণ করে।
বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এই দুর্ভিক্ষের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সহায়তা বন্ধ করে দেয়াকে দায়ী করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তাদের দাবী, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ছিল মানবসৃষ্ট। আর সেটা ছিল হেনরি কিসিঞ্জারের নিষ্ঠুরতম সিদ্ধান্ত।
সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলঃ MKN Bangla
ভিডিও লিংকঃ ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ছিল মানবসৃষ্ট (ভিডিও)