muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

জাতীয়

৪৩টি প্রতিষ্ঠানের ৯৭ চালানে পাচার ৩৫০ কোটি টাকা

পণ্য রপ্তানি করার এক বছর পার হলেও বিক্রয়মূল্য হিসেবে কোনো অর্থ দেশে আনা হয়নি। আবার বিদেশি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অর্থ পরিশোধ করা হলেও পণ্য আমদানি করে কারখানায় ঢোকানো হয়নি। এমন অনিয়ম করে অর্থ পাচার করেছে এমন ৯৭টি চালান চিহ্নিত করা হয়েছে।

অর্থপাচার রোধ এবং পাচার করা অর্থ থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে গঠিত কমিটি এসব চালান চিহ্নিত করেছে। এসব চালানের মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। এরই মধ্যে অর্থপাচারকারী ৪৩টি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়েছে। বাকি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করতে তদন্ত চলছে। অর্থপাচারে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত এবং হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

৯৭টি চালানের অনিয়মে জড়িত হিসেবে চিহ্নিত ৪৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে এবি ভেজিটেবিল অয়েল লিমিটেড, হলমার্ক নিটিং অ্যান্ড ডায়িং লি., হলমার্ক ডিজাইন লি., এমএবি পলি লিমিটেড, ন্যাশনাল প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লি., একে প্যাকেজিং, ইএন্ডসি ম্যানুফ্যাকচারিং লি., ওশান গার্মেন্টস লি., পদ্মা কালার ল্যাব লিমিটেড, রেইনবো গার্মেন্টস লি., রাজা প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লি.। আরো কয়টি প্রতিষ্ঠান এ অনিয়মে জড়িত তা চিহ্নিত করতে কাজ করছে অর্থপাচার রোধ করার লক্ষ্যে গঠিত কমিটি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখার সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি), ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল, শুল্ক শাখা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।

আমদানি বা রপ্তানিসংক্রান্ত ৯৭টি চালানের মধ্যে অনেকগুলো একই প্রতিষ্ঠানের নামে একাধিকবার করা হয়েছে। আবার একই ঠিকানা ব্যবহার করে একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন চালানে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা হয়। এসব চালানের বেশির ভাগই চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি হয়েছে।

৯৭টি চালানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, ডেনমার্ক, সুইডেন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যন্ড, সৌদি আরব, দুবাই ও যুক্তরাষ্ট্রে। এসব চালানে সবচেয়ে বেশিবার পণ্য আমদানি হয়েছে চীন, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া থেকে।

৯৭টি চালানে আমদানি-রপ্তানিতে জড়িত প্রতিটি অসাধু প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত অনিয়ম সম্পর্কে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থপাচার রোধ সংক্রান্ত কমিটি। চিঠি পাওয়ার পর ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে এক মাস সময় দেওয়া হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমেও এসব চালানের কোনটির সঙ্গে বাংলাদেশের কোন ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তারা জড়িত তা চিহ্নিত করা হবে। বিদেশে ক্রেতা ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হবে। এ ক্ষেত্রে তদন্তকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব প্রক্রিয়ায় তথ্য সংগ্রহ করবে। এর মধ্যে দ্বৈত কর চুক্তির আওতায়ও তথ্য সংগ্রহ করা হবে।

অর্থপাচার রোধ এবং পাচার করা অর্থ থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে কমিটি গঠন করা হয় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খানকে আহ্বায়ক করে। এ কমিটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানির তথ্য সংগ্রহ করে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে বড় অঙ্কের এ অনিয়ম চিহ্নিত করেছে কমিটি।

কমিটির আহ্বায়ক ড. মইনুল খান বলেন, ‘আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের তদন্তে বিষয়টি উদ্ঘাটিত হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে নজরদারি বাড়িয়েছি। আশা করি অর্থপাচারের মতো জঘন্য অপরাধ যারা করছে তাদের চিহ্নিত করতে পারব। কিছু প্রতিষ্ঠানকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারলে অন্যরা এ পথে আসবে না। এতে সৎ ও প্রকৃত ব্যবসায়ীরা সুস্থ প্রতিযোগিতায় ব্যবসা করতে পারবেন। দেশের অর্থনীতি উপকৃত হবে।’

দেশি-বিদেশি একাধিক প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচারের ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে। আমদানি-রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং, ভুয়া বা জাল তথ্য ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের বিষয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, পণ্য আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ২০১১ সালে ৪৭৫ কোটি ডলার, ২০১২ সালে ৬৫৫ কোটি ডলার, ২০১৩ সালে ৮৩৬ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। গত ১০ বছরে পণ্য আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ মোট ৪৯ হাজার ১৩ কোটি ডলার।

এনবিআরের প্রতিবেদনেও উল্লেখ আছে, বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থের ৮০ শতাংশই পাচার হয় বাণিজ্যের আড়ালে। অন্যদিকে এশিয়া-প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিং (এপিজি) অ্যান্ড কাউন্টারিং টেররিজম ফাইন্যান্সিংয়ের পাঠানো ‘সন্ত্রাসে অর্থায়ন এবং অর্থপাচার সম্পর্কিত কার্যক্রম পরিচালনায় বাংলাদেশের সক্ষমতা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে। অর্থপাচার রোধ এবং পাচারকৃত অর্থ থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে গঠিত কমিটির কাছে এ প্রতিবেদন পাঠিয়ে নজরদারি বাড়ানোর সুপারিশ জানিয়ে অর্থপাচার সম্পর্কিত কাজের অগ্রগতি তিন মাস পর পর জানানোর কথা বলা হয়।

এপিজির প্রতিবেদন পাওয়ার পর অর্থপাচার রোধ এবং পাচারকৃত অর্থ থেকে রাজস্ব আদায়ে গঠিত কমিটি নজরদারি বাড়ায়। তারা এনবিআরের ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানিতে জড়িত প্রতিষ্ঠানের কাছে ওই প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানি সম্পর্কিত তথ্য জানতে চেয়ে নির্দিষ্ট কিছু ছকের ফরম পাঠায়। এতে প্রতি মাসে কী পরিমাণ পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা হচ্ছে, কোন দেশে পাঠানো হচ্ছে, কোন দেশ থেকে আনা হচ্ছে, জড়িত অর্থের পরিমাণ কত তা জানতে চাওয়া হয়। প্রতি মাসে এ ফরম পূরণ করে অনলাইনে এনবিআরের ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলের তথ্যভাণ্ডারে জমা দিতে হয়। বিভিন্ন বন্দর থেকে কোন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কয়টি চালানে কী পরিমাণ অর্থ ও পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়েছে তা সংগ্রহ করা হচ্ছে। অর্থপাচার রোধে গঠিত কমিটি শুধু হালনাগাদ তথ্যই সংগ্রহ করছে না, বিগত দিনে বড় মাপের অনেক প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যও সংগ্রহ করছে। আবার বর্তমানে বন্ধ থাকা যেসব প্রতিষ্ঠান আগে বড় অঙ্কের আমদানি-রপ্তানি করেছিল তাদের বিষয়েও তদন্ত করছে। এসব তথ্য খতিয়ে দেখতে গিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানির এ অনিয়মের বিষয়টি নজরে আসে।

মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ ডটকম/06-04-2016/মইনুল হোসেন

Tags: