বিশ্বের যেসব দেশে বাঙালিরা অভিবাসী হিসেবে নোঙর গেড়েছে তার মধ্যে নি:সন্দেহে বিলেত অন্যতম। বিলেতে বাঙালির ইতিহাস শুরুর দিকে যতটা না কষ্টের আবরণে ঘেরা ছিল ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ততটাই আলোকিত। দেশটির বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশিদের পদচারণা বেশ পুরনো। বিলেতের কোন কোন শহরের রাস্তা-ঘাট, দোকান পাট গুলোতে বাঙালিদের আনাগোনা দেখে মনে হতে পারে এ যেন প্রবাসে একখণ্ড বাংলাদেশ।
বিলেতের লন্ডন শহরের এডলার স্ট্রীট, হোয়াইট চার্চ লেন এবং হোয়াইটচ্যাপেল হাই স্ট্রীটে অবস্থিত একটি ছোট পার্ক, যেটির আগের নাম ছিল সেন্ট মেরিস পার্ক। এই পার্কেই রয়েছে এক বাঙালির অনন্যকীর্তি। পার্কটির ভিতরে ঢুকতেই চোঁখে পরবে ইংরেজিতে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘আলতাব আলী পার্ক’।
আলতাব আলী লন্ডনের বাঙালি অভিবাসী ছিলেন। তিনি কারখানা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। গত শতকের সত্তরের দশকে ব্রিটেনে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন চলছিল। ১৯৭৮ সালের ৪ মে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে পূর্ব লন্ডনের এডলার স্ট্রিটে অজ্ঞাত কয়েকজন বর্ণবাদীর হাতে নির্মম ভাবে খুন হন তরুণ বাঙালি শ্রমিক আলতাব আলী।
বর্ণবাদী হামলায় আলতাব আলীর মৃত্যুতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ছিল হাজারো মানুষ। বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। মানুষ রাজপথে নেমে আসে। আলতাব আলীর মৃত্যু এই আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে কাজ করে।
ব্যাপক বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে আলতাব আলীর নাম। এজন্যই তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৯৮ সালে পূর্ব লন্ডনের এডলার স্ট্রিটে অবস্থিত সেন্ট মেরিস পার্ককে আলতাব আলী পার্ক নামকরণ করা হয়। লন্ডনে আলতাব আলীর নামে পার্ক বিদেশের মাটিতে বাঙালিদের নতুন সম্মান এনে দেয়।
আলতাব আলী পার্কের ভেতর ঢুকলেই মনে হবে আপনি যেন হঠাৎ করে একখণ্ড বাংলাদেশে এসেছেন। পার্কের চারদিকে উঁচু উঁচু গাছ। মাঠ ভরা সবুজ ঘাস। পার্কের ভেতরে রয়েছে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে একটা শহীদ মিনার। ১৯৯৯ সালে পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কের দক্ষিণ অংশে নির্মাণ করা হয় এই শহীদ মিনার; যা দেশের বাইরে বানানো প্রথম শহীদ মিনার।
আলতাব আলী ১৯৫৩ সালে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার সৈরদরগাঁও ইউনিয়নের মোল্লাআতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা হাজী আব্দুস সামাদ ও মা সোনাবান বিবির সাত সন্তানের মধ্যে আলতাব আলী ছিলেন সবার বড়। গোবিন্দগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করা আলতাব মদনমোহন কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা আনার জন্য যুক্তরাজ্য প্রবাসী চাচা আব্দুল হাসিমের সহায়তায় ১৯৬৯ সালে দেশটিতে পাড়ি জমান।
যুক্তরাজ্যে আলতাব একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। প্রায় ছয় বছর সেখানে অবস্থানের পর তিনি মায়ের সাথে দেখা করতে ১৯৭৫ সালে একবার বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ফিরে এসে তিনি বিয়ে করেন এবং ছয় মাসের মধ্যে আবারও যুক্তরাজ্যে ফিরে যান।