মানব ইতিহাসে যুগে যুগে ধর্মীয় গোঁড়ামী, কুসংস্কার ও সামাজিক কু-প্রথার ভয়াবহতার শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষ। আর মধ্যযুগ ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার সময়গুলোর একটি। সাধারণ মানুষের জন্য এই যুগটি ছিল অবিচারে পূর্ণ। বিশেষ করে নারীরা এসব নির্যাতনের শিকার হতো বেশি। সে যুগে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, দাসপ্রথা, সতীত্ব ধারণা ও সতীদাহ প্রথা ছিল উল্লেখযোগ্য। এই প্রথা শুধু অমানবিকই নয়, বরং তা শাস্ত্র ও আইনবিরুদ্ধ। এরধ্যে সতীদাহ প্রথা পৃথিবীর সকল নিদারুণ পৈশাচিক বর্বরতাকেও হার মানায়।
সতীদাহ প্রথা হলো সনাতন ধর্মাবলম্বী কোনো সদ্য বিধবা নারীকে স্বামীর চিতায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারার এক অমানবিক প্রথা। যা ধর্মের পথ ধরে জীবন্ত মৃত্যুর অনিবার্য পরিণতি।
সেই সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের কারো পরিবারে নাবালিকা মেয়ে থাকলে বাবা মায়ের দুশ্চিন্তা বেড়ে যেত। কোনো নাবালিকা মেয়ে ঘরে থাকলে সে পরিবারকে সমাজচ্যুত করা হতো। ফলে তার তিনগুণ বয়সী কিংবা বৃদ্ধের সঙ্গেও নাবালিকা কন্যার বিয়ের ঘটনা ঘটত। স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রীকে যেতে হতো সহমরণে। প্রতিবাদ করলে তাকে আফিমজাতীয় মাদকদ্রব্য খাইয়ে বা মাথার পেছনে আঘাত করে অজ্ঞান করে হাত-পা বেঁধে স্বামীর চিতায় তুলে ভস্ম করে দেওয়া হতো।
সেই প্রথা বা রীতি আজ পৃথিবীতে বিলুপ্ত। তবু কালের নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার কিছু স্মৃতিচিহ্ন। বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মতো কিশোরগঞ্জেও এ প্রথা চালু ছিল। তার করুণ স্মৃতি আজও বর্তমান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার গুজাদিয়া ইউনিয়নের জ্ঞানদা সুন্দরী সতীদাহ মঠ, জঙ্গলবাড়ির পূর্বপাশে নরসুন্দার তীরের গোড়াঘাট, তাড়াইল উপজেলায় সতীরগাঁও ও সতীরভিটা, বাজিতপুরের হিলচিয়ার সতীরখাল, কুলিয়ারচর উপজেলায় ছয়জনের সহমরণের স্মৃতি নিয়ে গঠিত ছয়সূতী গ্রাম।
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে ভারতবর্ষে সেই জঘন্য সতীদাহ প্রথায় বলি হওয়া জ্ঞানদা সুন্দরী সহমরন মঠ। প্রায় দু’শ বছরের পুরনো এ মঠের ইটের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে জ্ঞানদা সুন্দরীর আত্মাহুতির করুণ গাঁথা। আজও কানে ভাসে ঢাকঢোল, শঙ্খ, ঘণ্টার আওয়াজ আর চারপাশের মানুষের হইহল্লার আড়ালে চাপা পড়া বিধবার আহাজারির করুণ কন্ঠ।
ইতিহাস ও জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার গুজাদিয়া রামনগর গ্রামের তৎকালীন জমিদার নরসিংহ বাবু পরিবারের এক সদস্যের (বাংলা ১২৩৪ সালের ২৬ বৈশাখ) মৃত্যু হলে তার স্ত্রী জ্ঞানদা সুন্দরীকেও স্বামীর সঙ্গে জ্বলন্ত চিতায় আত্মাহুতিতে বাধ্য করা হয়। এ ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলে শেষ পর্যন্ত বিষয়টি আদালতে গড়ায়। পরে জ্ঞানদার ছেলে গয়ারাম চক্রবর্তীকে ৬ মাসের জেল দেয় আদালত। অনুতপ্ত হয়ে গয়ারাম চক্রবর্তী মায়ের চিতাস্থলে স্মৃতিসরূপ নির্মাণ করেন একটি মঠ।
নরসুন্দা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা এ সহমরন মঠটির বর্তমান অবস্থা খুবই বেহাল। মঠটি একদিকে হেলে পড়েছে। একপাশ দিয়ে মাঝখানে একটি অংশ ভেঙে গেছে। লতাপাতা ও বটবৃক্ষ আঁকড়ে ধরেছে জরাজীর্ণ মঠটির চারপাশ। যেকোনো সময় মঠটি ভেঙ্গে পড়তে পারে। এদিকে মঠটির চারপাশের জমি অনেকটাই বেদখল হয়ে গেছে।
করিমগঞ্জ উপজেলা শ্মশান কমিটির সাধারণ সম্পাদক পরিমল সরকার জানান, জ্ঞানদা সুন্দরীর সহমরন মঠটি মধ্যযুগের রক্ষণশীল হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উগ্রবাদ ও কুসংস্কারের নির্মম ইতিহাসকে বুকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। তবে এটির আজ রুগ্নদশা। অযত্ন অবহেলায় মঠটি ধ্বংসপ্রায়। তার ওপর মঠের ৫ শতাংশ ও পার্শ্বস্থ মন্দিরের ২ শতাংশসহ মোট ৭ শতাংশ জমির অনেকটা স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে। মঠটির বেদখলীয় জমি উদ্ধার ও সংস্কার-সংরক্ষণ আজ সময়ের দাবি।
প্যারাডাইস স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক রঞ্জন কুমার সরকার জানান, সতীদাহ প্রথা ছিল মূলত সামাজিক ও ধর্মীয় হত্যাকাণ্ড। যা জ্ঞানদা সুন্দরীর ধর্মের পথ ধরে জীবন্ত মৃত্যুর অনিবার্য পরিণতি। এ যুগের মানুষকে সেই নিষ্ঠুর কাহিনী জানানোর জন্য মঠটি সংস্কার করা প্রয়োজন।
এদিকে মধ্যযুগে রক্ষণশীল হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় কুসংস্কার, কু-প্রথা আর অমানবিক ঘটনা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এটি সংস্কার ও সংরক্ষণ খুবই জরুরি বলে দাবি তোলেন কলেজ পড়ুয়া ছাত্র আব্দুল্লাহ।
করিমগঞ্জের লোক সংগ্রাহক নজির আহমেদ বলেন, ‘এক সময় আমাদের দেশের গ্রামে-গঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন কুসংস্কার ছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর ঢাক-ঢোল পিটিয়ে স্ত্রীকে স্বামীর সঙ্গে চিতায় পুড়িয়ে মারা হতো। এটি ছিল খুবই জঘন্য রীতি। আইন করে সতীদাহ বন্ধ করার পরও অনেক স্থানে গোপনে এমন অপকর্ম চলতো। জ্ঞানদা তাদেরই একজন। অনিচ্ছা সত্তেও যাকে হাত-পা বেঁধে স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এ মঠটি অবশ্যই সংস্কার-সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
প্রাচীন র্কীতিরাজি আর প্রত্ন সম্পদ আবিষ্কার , উদ্ধার ও যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ করা আমাদের সবার জাতীয় দায়িত্ব। তেমনি আমাদের জাতীয় দায়িত্ববোধ থেকে জ্ঞানাদা সুন্দরী সহমরন মঠটি সংরক্ষণ ও সংস্কার জন্য দ্রুত প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সহায়তায় চাওয়া হবে। আর মঠটির বেদখল হওয়া জমি দ্রুত উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হবে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পলাশ কুমার বসু।
উল্লেখ্য, ১৭৯৯ সালে খ্রিষ্টান যাজক ও বাংলায় গদ্য পাঠ্যপুস্তকের প্রবর্তক উইলিয়াম কেরি এই প্রথা বন্ধের প্রয়াস নেন। গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলির কাছে তিনি সতীদাহ বন্ধের আবেদন জানান। এরপর রামমোহন রায় ১৮১২ সালে সতীদাহবিরোধী সামাজিক আন্দোলন শুরু করেন। ১৮২৮ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক বাংলার গভর্নর হয়ে আসলে তার কাছে রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্য আবেদন করেন। লর্ড বেন্টিঙ্ক রামমোহনের যুক্তির সারবত্তা অনুভব করে আইনটি তিনি ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথাকে নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে আইন পাস করেন। পরে হিন্দু সমাজের রক্ষণশীল ব্যক্তিরা এই আইনকে হিন্দু ধর্মের ওপর আঘাত হিসেবে অভিহিত করে 'ধর্মসভা' গঠন করে তাঁরা লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে আপিলও করেন। আপিলটি দিল্লির বাদশাহ আকবরের সহায়তায় ১৮৩২ সালে প্রিভি কাউন্সিল রক্ষণশীল হিন্দুদের আপিল খারিজ করে লর্ড বেন্টিঙ্কের আদেশ বহাল রাখেন। এরপর ভারতবর্ষ থেকে সতীদাহ প্রথা পুরোপুরি বন্ধ করতে আরও তিন দশক লেগে যায়।