কারাবন্দী যুব মহিলা লীগের সাবেক নেত্রী শামীমা নুর পাপিয়াকে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগার থেকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গতকাল সোমবার বিকেল ৫টায় বিশেষ নিরাপত্তায় তাকে কুমিল্লা কারাগারে পাঠানো হয়।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার (ভারপ্রাপ্ত) ওবায়দুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার কারণে কারাগারের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বন্দী শামীমা নুর পাপিয়াকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে।
জানা যায়, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারে বন্দী থাকার সময় পাপিয়া ও তার অপর সহযোগীর বিরুদ্ধে কারাগারের হাজতি ও শিক্ষানবিশ আইনজীবি রুনা লায়লাকে নির্যাতন এবং তার কাছে থাকা টাকা-পায়সা লুট করার অভিযোগ ওঠে।
নির্যাতনের শিকার রুনা লায়লা গাজীপুরের কাপাসিয়া থানার কড়িহাতা গ্রামের আব্দুল হাইয়ের মেয়ে এবং মৃত এ কে এম মাহমুদুল হকের স্ত্রী। তিনি ঢাকার কোতোয়ালি থানার ৭৩৫ নম্বর মামলার আসামি।
গত ১৬ জুন থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিলেন রুনা লায়লা। তিনি গত ২৭ জুন জামিনে মুক্তি পেয়ে বর্তমানে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
রুনা লায়লার ভাই আব্দুল করিম এ বিষয়ে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কাছে গত ২৫ জুন লিখিত অভিযোগ করলে বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
আব্দুল করিম জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগে বলেন, ‘গত ২২ জুন সকাল ১০ টায় কাশিমপুর কারাগারে বন্দী আমার বোনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আমার বোনের নাম ঠিকানা নেওয়ার ৩ ঘন্টা পরে সাক্ষাতের টিকেট কাউন্টার থেকে আমাকে জানানো হয় ‘ডিও নাই’ দেখা করা যাবে না। তারপরও আমি সেখানে অপেক্ষা করতে থাকি। পরে জামিনে বের হয়ে আসা অন্য হাজতিদের কাছে আমার বোন সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা আমাকে জানায়, আমার বোন রুনা লায়লাকে পিটিয়ে মারাত্মক আহত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। তখন আমি উদ্বিগ্ন হয়ে ফিরে যাই এবং পরের দিন আবার কারাগারে আমার বোনের সঙ্গে দেখা করতে যাই। পরে জানতে পারি, আমার বোনের কাছে ৭ হাজার ৪০০ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। সেই টাকা কেড়ে নেওয়ার জন্য কারাগারে দায়িত্বে থাকা মেট্টন হাবিলদার ফাতেমা বেগম, নাসিমা আক্তার, হাজতি ও কয়েদিসহ যুব মহিলালীগ থেকে বহিস্কৃত নেত্রী কারাবন্দি শামীমা নুর পাপিয়া, সোনালী, আনন্দিকা, অবন্তিকা ও নাজমা আমার বোনকে (সিসি ক্যামেরা নেই এমন স্থানে নিয়ে) বেধড়ক পিটিয়ে মারাত্মক আহত করে। এক পর্যায়ে আমার বোন রক্ত বমি করে এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জ্ঞান ফেরার পর আবারও তাকে পেটানো হয়।’
আব্দুল করিম আরও অভিযোগ করেন, ‘২৩ জুন আমার বোনের সঙ্গে দেখা করার জন্য ফের কারাগারের সাক্ষাৎ কাউন্টারে টিকেট কাটতে গেলে টিকেট ম্যান আমাকে কাশিমপুর কারাগারের অভিযোগ কেন্দ্রের ইনচার্জ আলেয়ার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। আমরা আলেয়ার কাছে গেলে তিনি আমাদের বসিয়ে রেখে ডেপুটি জেলার জান্নাতুল তায়েবাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসেন। জান্নাতুল তায়েবার কাছে আমার বোনকে মারধর করে আহত করার কথা জানালে তিনি বলেন, আপনার বোনের কিছু হয়নি। আমার বোনের সঙ্গে দেখা করার কথা বললে জান্নাতুল তায়েবা বলেন, দেখা করা যাবে না। তখন জান্নাতুল তায়েবার সঙ্গে আমাদের কথা কাটাকাটি হয়। কিন্তু কোন অবস্থাতেই জান্নাতুল তায়েবা আমার বোনের সঙ্গে আমাদের দেখা করতে দেননি।’
রুনার ভাই অভিযোগ করে বলেন, ‘ডেপুটি জেলার জান্নাতুল তায়েবা আমার বোনের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দিতে চান। পরে দুপুর ২টায় একটি মোবাইল ফোনে অপরিচিত মহিলার কণ্ঠে আমার বোন বলে পরিচয় দিয়ে কথা বলান। কিন্তু ওই মহিলা আমার বোন রুনা লায়লা ছিল না। রুনা সাজিয়ে অন্য মেয়েকে দিয়ে কথা বলানো হয়। ডেপুটি জেলার জান্নাতুল তায়েবা অন্য একজন মহিলাকে আমার বোন সাজিয়ে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। উক্ত বিষয়টি ওই কারা কর্তৃপক্ষকে অবগত হওয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।’
কারা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, নথি চুরির একটি মামলায় শিক্ষানবিশ আইনজীবী রুনা লায়লাকে ১৬ জুন কাশিমপুর মহিলা কারাগারে আনা হয়। কারাগারের সাধারণ ওয়ার্ডে নেওয়ার পর রুনার দেহ তল্লাশি করে কর্তব্যরত মেট্টন তার কাছে ৭ হাজার ৪০০ টাকা পান। ওই টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য পাপিয়া ও তার সহযোগীরা ১৯ জুন রুনাকে নির্যাতন শুরু করেন বলে অভিযোগ তার পরিবারের।
একপর্যায়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রুনাকে মেঝেতে ফেলে রাখা হয়। এ নিয়ে কারাগারের ভেতরে কেস টেবিল বা সালিস বসে। সেখানে ত্রিমুখী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন বন্দী ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্মচারীরা। তবে পাপিয়ার ভয়ে সাধারণ কয়েদিরা রুনা লায়লার ওপর অমানুষিক নির্যাতনের প্রতিবাদও করতে পারেননি।
জানতে চাইলে সিনিয়র জেল সুপার (ভারপ্রাপ্ত) মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘এক বন্দীকে নির্যাতনের ঘটনায় তিনজনকে শোকজ করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ঘটনাটি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। শোকজ করা তিনজন হলেন-কারাগারের জেলার ফারহানা আক্তার, ডেপুটি জেলার জান্নাতুল তায়েবা ও মেট্রন হাবিলদার ফাতেমা।’
তদন্ত প্রতিবেদন জমা হলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া কারাগারের ভেতরে এমন ঘটনা যাতে আর না হয়, সে বিষয়েও খোঁজখবর রাখা হচ্ছে বলেও জানান এই জেল সুপার।