ফরিদপুরের দু’ভাইয়ের দুই হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির মামলার আসামি সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশারফ হোসেনের ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন ওরফে বাবর হাজতখানায় অসুস্থ হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
অন্যদিকে এ মামলায় গত ২৫ জুন অধিকতর তদন্তে আরও ৩৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে দাখিলকৃত সম্পূরক চার্জশিটের বিষয়ে শুনানি হয়েছে। ঢাকার ৯ নম্বর বিশেষ জজ বিচারক শেখ হাফিজুর রহমান এ শুনানি গ্রহণ করেন। এরপর তিনি এ বিষয়ে আইনানুগ আদেশ হতে বলে জানিয়েছেন।
আসামি বাবরের অসুস্থ হওয়ার বিষয়ে মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাজত খানার ইনচার্জ সাব-ইন্সপেক্টর সাদিকুল ইসলাম বলেন, ‘আজ বুধবার সকাল ৯টায় কেরানীগঞ্জ জেলখানা থেকে অন্য আসামিদের সঙ্গে এ মামলার আসামি বাবর আদালতে আনা হয়। এরপর তাদের আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। এর কিছুক্ষণ পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে তাকে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে পুলিশ পাহারায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।’
এ মামলায় ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (বহিস্কৃত) মো. সাজ্জাদ হোসেন মণ্ডল ওরফে সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি (বহিস্কৃত) ইমতিয়াজ হাসান রুবেল (৪৫) সহোদরসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে প্রথম চার্জশিট দাখিল হয়।
মামলাটির অধিকতর তদন্তে আরও ৩৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালকে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। প্রথম চার্জশিটের অপর ৮ আসামি হলেন- ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি খন্দকার নাজমুল হাসান লেভী ও শহর যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসিবুর রহমান ফারহান, এএইচ এম ফুয়াদ, ফাহাদ বিন ওয়াজেদ ফাহীন ওরফে ফাহিম, কামরুল হাসান ডেবিট, মোহাম্মাদ আলী ওরফে মিনার, তারিকুল ইসলাম নাছিম ও সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশারফ হোসেনর ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন ওরফে বাবর।
সম্পূরক চার্জশিটের নতুন আসামিরা হলেন- নিশান মাহমুদ ওরফে শামীম, মো. বিল্লাল হোসেন, মো. সিদ্দিকুর রহমান ওরফে সিদ্দিক, মো. সাইফুল ইসলাম জীবন, অনিমেশ রায়, সামচুল আলম চৌধুরী, দিপক মজুমদার, শেখ মাহতাব আলী মেথু, সত্যজিত মুখার্জি, মো. সহীদুল ইসলাম ওরফে মজনু, ফকির মো. বেলায়েত হোসেন, গোলাম মো. নাসির, মো. জামাল আহমেদ ওরফে জামাল, বেলায়েত মোল্লা, মো. আফজাল হোসেন খান ওরফে শিপলু, অমিতাভ বোস, চৌধুরী মো. হাসান, মো. জাফর ইকবাল ওরফে হারুন মন্ডল, আসামি বরকতের স্ত্রী আফরোজা পারভীন, আসামি রুবেলের স্ত্রী সোহেলী ইমরোজ পুনম, সাহেব সারোয়ার, সাজ্জাদ হুসাইন বাবু, স্বপন কুমার পাল, মো. জাহিদ ব্যাপরী, খলিফা কামাল, মো. নাজিমুল হোসেন ওরফে তাপস, রিয়াজ আহমেদ শান্ত, আনোয়ার হোসেন আবু, মোহাম্মাদ মানরুজ্জামান ওরফে মনিরুজ্জামান মামুন, মাফুজুর রহমান মামুন, সুমন সাহা, মো. আব্দুল জলিল শেখ ওরফে জলিল, মো. রফিক মণ্ডল, মো. আজমল হোসেন খান ওরফে ছোট আজম, খন্দকার শাহীন আহমেদ ওরফে পান শাহীন ও মোহাম্মাদ আরিফুর রহমান ওরফে দোলন।
আসামিদের মধ্যে রুবেল, বরকত, নিশান মাহমুদ ওরফে শামীম, মো. বিল্লাল হোসেন, মাফুজুর রহমান মামুন, সুমন সাহা, মো. আব্দুল জলিল সেখ ওরফে জলিল ও মো. রফিক মণ্ডল গ্রেপ্তার হয়েছেন।
২০২১ সালের গত ৩ মার্চ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ কমিশনার (এএসপি) উত্তম কুমার সাহা প্রথম চার্জশিট আদালতে দাখিল করেন।
এরপর মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার দশ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে যায়। সেখানে কয়েক দফা চার্জগঠনের শুনানি হয়। শুনানিতে কিছু ত্রুতি-বিচ্যুতি ওঠে আসে। যার মধ্যে মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়া এবং স্বীকারোক্তিতে নাম নাম আসা ৪২ জনকে বাদ দেওয়া হয়। বাদ দেয়া ৪২ জনের মধ্যে ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিশান মাহমুদ শামীম ও বিল্লাল হোসেন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন। এই দুই জনের নাম বাদ দেওয়া এবং দুই ভাইয়ের যে সম্পত্তি থাকার কথা চার্জশিটে বলা হয় সে হিসাবে গড়মিল থাকয় রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন।
মামলায় এর আগে দুই সহোদরের ৫ হাজার ৭০৬ বিঘা জমি, ৫৫টি গাড়ি ক্রোক ও ১৮৮টি ব্যাংক হিসাবে থাকা ৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ফ্রিজের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
মামলার বিবরণে বলা হয়, আসামি বরকত ও রুবেল ফরিদপুর জেলার কোতয়ালী থানাধীন ব্রাক্ষণকান্দা গ্রামের মৃত আব্দৃস সালাম মণ্ডলের ছেলে। তারা প্রথম জীবনে ফরিদপুর জেলার রাজবাড়ী মোড়ে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা চাঁন খন্দকারের অফিসে চা-পান সরবরাহ করত। ১৯৯৪ সালে চাঁন খন্দকরের নির্দেশে এ দুই ভাই ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক অ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন খোকনকে নির্মমভাবে হত্যা করে মর্মে বরকতসহ অন্যান্যদের ফরিদপুর কোতয়ালী থানায় মামলা হয়। পরবর্তীতে মামলাটির তদন্ত শেষে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগপত্র দাখিল করে। ২০০২ সালের পর বরকত ও রুবেল তাদের গুন্ডাবাহিনী নিয়ে ফরিদপুর বাসস্ট্যান্ড, ট্রাকস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা ব্যাপকভাবে শুরু করে।
মামলায় বলা হয়, ২০০৮ সাল থেকে বরকত ও রুবেল সহোদর ফরিদপুর জেলার এলজিইডি, বিআরটিএ, রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, পাসপোর্ট অফিস, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারী তারা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদের লোকজন দিয়ে পরিচালনা করে অবৈধ পন্থায় কোটি কোটি টাকা চাঁদা করে এবং মাদক ব্যবসায় তাদের মনোনীত লোকজন দিয়ে পরিচালনা করে প্রচুর অংকের টাকা অবৈধভাবে অর্জন করেন।
মামলায় বলা হয়, ঢাকা শহরের কাফরুল থানাধীন মহাখালী ডিগএইচএস বাড়ী নং-৩১৬, রোড নং-২১, লেভেল নিউ ডিওএইচএস এ অফিস ভাড়া নিয়ে বাংলাদেশের সকল এলজিইডি অফিসের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে চাঁদাবাজির মাধ্যমে বিগত দুই দশকের মধ্যে তারা অর্জিত অবৈধ অর্থের দ্বারা সাউথ লাইন যাত্রী পরিবহনের এসি/ননএসি ২৪টি বাস, ১০টি ট্রাক, দুইটি পাজেরো, দুইটি মাইক্রোবাস, ১টি নিশান মিনিবাস। যার অধিকাংশ নম্বরহীন। এছাড়া ১টি গেস্ট হাউজ, ৮ হাজার বর্গফিটের উপর নবনির্মিত বিণ্ডিং, বরকত এগ্রো প্রা. লিমিটেড, মেসাস এসবি ডেইরি ফার্ম, নর্থ চ্যানেল বাগানবাড়ী, এসবি ব্রিকফিল্ড, এসবি পাথর ক্রসিং, এসবি প্রেস, এসবি ট্রেডার্স, বরকত কনষ্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ও ১টি পেট্রোল পাম্প প্রতিষ্ঠা করে। মামলায় বলা হয়, আসামিগণ অবৈধ পন্থায় অর্জিত টাকা দ্বারা উল্লেখিত সম্পদের মালিক হয়েছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে তাদের সম্পত্তির মূল্য অনুমান ২ হাজার কোটি টাকা।