muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

বিনোদন

শিকারি রোমিও-জুলিয়েট

বিনোদন ডেস্কঃ দক্ষিণের সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসছে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। এর প্রভাবে রোদেলা আকাশ জুড়ে মেঘের আনাগোনা। দুইদিনে বৃষ্টিও হয়েছে কয়েক পশলা।

 

পরিকল্পনার শুরু থেকেই দোটানাটানির মধ্যে ছিলাম। তার অন্যতম কারণ বৃষ্টি। বৃষ্টিই যদি না থাকে তাহলে ঝর্ণা দেখতে যাওয়াটা অর্থহীন। ওদিকে সরকারি ছুটি তো আর বৃষ্টির হিসাব-নিকাস মোতাবেক আসে না। সাপ্তাহিক ছুটি এবং শব-ই-বরাত, এই দুয়ে মিলে তিনদিন, সাথে চেষ্টা করলে অতিরিক্ত দিন দুই বাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব।

 

সহযাত্রী দুজন তাই করল। আর আমার তো ওসবের বালাই নেই। এই ছুটিতে বেড়াতে না পারলে তাদের জন্য বড় লোকসান, প্রতীক্ষা করতে হবে কয়েক মাস। কাকতালীয়ভাবে বৃষ্টি এবং ছুটি দুই সোনায় সোহাগার মত মিলে গেল। দুইদিন হাঁটার পর তৃতীয় দিনেও হাঁটছি।

 

খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে ঝড়ো বাতাসের মাঝে বৃষ্টি মাথায় এগিয়ে যাচ্ছি। ছাতা থাকায় কিছুটা রক্ষা যেমন হয়েছে তেমনি ভোগান্তিও পোহাতে হয়েছে। পাহাড়ী পথে এমনিতেই হেঁটে চলা কঠিন একটি কাজ, তার ওপর দিয়ে আবার ছাতা সামলানো। পাহাড় টপকাতেই মেঘের আড়াল ভেঙ্গে চোখে ধরা দিল দূরের একটি বসতি।

 

রোমিও-জুলিয়েটের সাথে বিপ্লব

 

বাতাস বইছে। ছাতা গুটিয়ে ব্যাগে রাখলাম আর মাথায় পেচিয়ে নিলাম একটি পলিথিন ব্যাগ। বসতিটায় পৌঁছে গেলাম। কয়েক দিনের বৃষ্টিতে বসতির আঙ্গিনার সমস্ত ধুলাবালি ও ময়লা আবর্জনা ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে গেছে। লাল মাটির আঙ্গিনা অধিক লাল বর্ণ ধারণ করেছে। একটি মানুষও নেই। নিরব নিস্তব্ধ বসতির ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বাতাস আর অঝরে বৃষ্টি।

 

সময় সকাল সাড়ে নয়টা। পাহাড়ে এই সময় মানে অনেক বেলা। তারা যেমন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে তেমনি জাগেও আগেভাগে। বৃষ্টির দিন তাই বাইরে কোনো কাজ করার সুযোগ নেই। বসতির সমস্ত লোক আরাম করে ঘুমাচ্ছে। অসমতল দীর্ঘ আঙ্গিনা বা উঠানে আমরা তিনজন আগন্তুক মাত্র। ভেবে পাচ্ছি না কী করা যেতে পারে! কাকে ডাকি? কিভাবে ডাকি? নানান কিছু ভাবছি। এর মধ্যে অতিবাহিত হয়ে গেছে প্রায় ১৫ মিনিট।

 

 

ঘরের দরজায় গিয়ে কয়েকটা ডাক দিতেই বেরিয়ে এলেন কারবারী শুশীল তঞ্চঙ্গা। কে জানে কতদিন পর এমন একটা প্রশান্তির ঘুম দিয়েছিলেন। তার ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য নিজেদেরকে অপরাধীই মনে হল। দুএক কথা চলমান, কি উদ্দেশ্য, কেন এসেছি ইত্যাদি। আশপাশে তাকিয়ে দেখি আমাদের ডাকাডাকি আর কথপোকথনের শব্দে অন্য সব ঘরের লোকেরা জেগে গেছে। আমাদের তিনজনের হাতে আবার পথে পাওয়া একটি করে কুমড়া। কেউ দরজার চেগারের ফাঁক দিয়ে তো কেউ জানালার ফাঁক দিয়ে কৌতূহলে আমাদেরকে দেখছে। পিঠে একটি করে ব্যাগ, মাথায় পলিথিন, হাতে একটি বা দুটি করে লাঠি, সর্বসাকুল্যে ভেজা জুবুথুবু অচেনা তিনটি মানুষ দেখে সদ্য ঘুম ভাঙ্গা শিশুদের জোড়া জোড়া চোখ যেন বিস্ময়।

 

বৃষ্টি থেমে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যে বসতি ঢেকে গেল এক পড়ত পাতলা মেঘে। একজন, দুজন বা কোনো বিয়ে বাড়ির সমস্ত মানুষের ঘুম ভাঙ্গানোর অভিজ্ঞতা অনেকেরই থাকে কিন্তু একটি বসতির ঘুম ভাঙ্গানো বা তাদেরকে জেগে তোলা, আমার কাছে এক বিশেষ অভিজ্ঞতা।

 

খাল ধরে এগিয়ে যাওয়া

কারবারীর স্ত্রী ইতিমধ্যেই ঘরের বিছানাপত্র গুছিয়ে পরিপাটি করে ফেলেছেন। এবার ঘরে বসতে দিয়ে শুনলেন আমাদের উদ্দেশ্যের বিস্তারিত। চিন্তায় নিজ মাথায় হাত নাড়তে নাড়তে কারবারী ভাঙ্গা বাংলায় বললেন, ’উহ, সে তো অনেক কষ্ট আর দূরে!’ শহুরে মানুষ দেখে তাদের পক্ষে এমন কথা ভাবাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমাদের পূর্বাভিজ্ঞতা আর সামর্থের মোটামুটি ফিরিস্তি পেশ করার পর পাশের ঘর থেকে ডেকে তুললেন তার ছেলে বিপ্লব তঞ্চঙ্গাকে।

 

চোখে ডলা দিতে দিতে ১৪-১৫ বছরের কিশোর বিপ্লব বলল, ’আমি পাইন্দু সাইতার নিয়ে যেতে পারবে যে।’বিপ্লব বাংলা ভালো বলতে পারে না। অনেক পথ। তাই সে ভাত খেয়ে নিল। সে ফাঁকে আমরাও ব্যাগে রাখা শুকনো খাবারে উদর পুর্তি করে বিশ মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে নিলাম। পাহাড়ীদের চলার পথের সার্বক্ষণিক হাতিয়ার দা। বিপ্লব হাতে একটি দা নিয়ে চলো, বলে যাত্রা শুরু করলো। বসতির শেষ প্রান্তের ঘরটার কাছাকাছি গেলে কৌতূহলে এগিয়ে আসে উপজেলা সদর উচ্চবিদ্যালয়ে পড়া তার বন্ধু জিবন তঞ্চঙ্গা। বলে, আনন্দ করার জন্য আপনাদের সাথে আমিও যেতে চাই।

 

খাল ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। কিছু দূর যাওয়ার পর আগে-পিছে আবিস্কৃত হয় দুইটি ডোরাকাটা কুকুর। আমরা তখনও জানি না ওরাও আমাদের সহযাত্রী। দেশের পার্বত্য অঞ্চলের গভীরে এমন ডোরাকাটা কুকুর প্রায়ই দেখা যায়। একটা সময় তো আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে স্ট্রাইপ হায়েনার অস্তিত্বও ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে সহযাত্রী মির্জা রাসেলের হাস্যরস অভিমত, হয়তো কোনো এক সময় কুকুর হায়েনার সঙ্করায়ণের ফল বর্তমানের এই স্ট্রাইপ কুকুর।

 

শিকার করা গুইশাপ হাতে জিবন

 

কয়েক দিনের বৃষ্টিতে ঝিরি পথের পানি বাড়তির দিকে। আমাদের গন্তব্যের পথ ঐ একটাই।

 

বিপ্লব এবং জিবন আমাদের পথ প্রদর্শকের ভূমিকা যতটা না পালন করল তার চেয়ে যেন অধিক করল রোমিও-জুলিয়েট (কুকুর দুটির নাম)। ওরা সর্বক্ষণ বিপ্লবের সাথে থাকে, এমন কি খাওয়া ও ঘুমানোর সময়েও। আদর করে দুজনের সে এমন নাম দিয়েছে। এতিম কুকুর দুটির বর্তমানে মা-বাবা বলতে কেবল বিপ্লব। একটা পর্যায়ে গিয়ে খাল ছেড়ে উঠে যেতে হল উপরের দিকে। এতটাই উপরে আরোহণ করলাম যে, দূরে পাইন্দু খালকে সবুজর মাঝে পড়ে থাকা আঁকাবাঁকা একটি দড়ির মত মনে হল। রোমিও-জুলিয়েট থমকে দাঁড়ালো। আচরণে ফুটে উঠল খানিকটা ভিন্নতা। কান খাড়া করে দুজোড়া চোখের দৃষ্টি পথের পাশের পাথরগুলোর দিকে। ঘটে গেল এক অসাধারণ ঘটনা। জুলিয়েট এক লাফে গিয়ে কামড়ে ধরল একটি গুইশাপের ঘাড়, সাথে রোমিও। বিপ্লব তার নিজ ভাষায় কুকুর দুটিকে নির্দেশ করে উচ্চ শব্দে কিছু একটা বলতে থাকলো। ধর ধর, ছারবি না এমন কিছু। গুইশাপের সাথে লুটোপুটি খেতে খেতে তারা দুজন গড়িয়ে পড়লো বেশ খানিকটা নিচে। পাঁচ মিনিট পর জঙ্গলের ভেতর থেকে শাপটিকে দাঁত দিয়ে খামচে ধরে উঠে এলো রোমিও আর পিছে পিছে ক্লান্ত-শ্রান্ত জুলিয়েট। পিঠে চাপড় মেরে বাহবা জানিয়ে বিপ্লব তার শিকারের দুই সতীর্থকে আনন্দে উপর্যুপরি চুমু খেয়ে যেন শিক্ত করে দিল। সভ্যতার ক্রমবিকাশ বিষয়ক পঠন-পাঠনে গেলে দেখা যায়, শেষ বরফ যুগের পর আজকের এই সভ্যতা কিরূপ পরিক্রমার মাঝ দিয়ে এগিয়েছে।

 

আমরা সেখানে দেখতে পাই হাতিয়ার আবিস্কারেরও আগে আদিম  মানুষ সর্বপ্রথম পোষ মানাতে সক্ষম হয়েছিল এই কুকুরকে। লক্ষ বছর পূর্বে মানুষ আর কুকুরের সখ্যতার সেই পরম্পরা আজও অটুট রয়েছে। যার চাক্ষুস নজীর প্রত্যক্ষ করার পর আমাদের সেই পূর্বপুরুষদের  প্রতি শ্রদ্ধায় যেন মাথা নত হয়ে এলো। কুকুরকে পোষ মানানোর অনবদ্য শিক্ষাটি আজও আমাদেরকে কতভাবে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি আজ কেবল শিকার কাজের মাঝেই সীমবদ্ধ নেই বরং ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক নানাবিধ কাজে। স্থানীয় ভাষায় এইগুলো খেতে নাকি অনেক মজা। বলতে বলতে বিপ্লব আর জিবনের মুখে যেন তখনই জল চলে এলো।

 

এই সময়টা বৃষ্টি ছিল না। পথ ভালোই এগোচ্ছিল। প্রথমে টিপ টিপ খানিক বাদে শুরু হল অঝোরে। এরই মধ্যে আমরা নেমে পড়েছি পাইন্দু খালে। পাহাড়ী নদী এবং খালের বৈশিষ্ট্য হল, প্রবল বর্ষণে সর্বোচ্চ এক ঘন্টার মধ্যেই ঢল নেমে যায়। ঝর্ণার নিকট যেতে যেতে কোমর পানি এসে ঠেকল বুকে। সাথে বাড়তে থাকল ঝুকি। সামান্য এদিক সেদিক হলেই ঘটে যেতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। জুলিয়েট সাঁতারটা এখনও ভালো মত শিখে উঠতে পারেনি। জায়গায় জায়গায় বিপ্লব তাকে কোলে তুলে পার করে চলতে সাহায্য করল। দূর থেকে ঝর্ণার উপরিভাগটা দেখা গেলেও সম্পূর্ণটা নয় কারণ পাশের পাহাড় থেকে ধসে পড়া বোল্ডার পাথর খন্ডের পেছনে তা আড়াল হয়ে রয়েছে। বোল্ডারগুলো ডিঙ্গিয়ে সম্মুখে ধরা দিল পূর্ণাঙ্গ পাইন্দু ঝর্না। পার্বত্য অঞ্চলে দেখা সবচেয়ে সুন্দর ঝর্ণা এটি আবার বিপজ্জনক। ঝর্ণার পেছনের দেয়ালটা ভেঙ্গে ভেঙ্গে তৈরি হয়েছে বড়সড় গুহা সদৃশ একটি ছাউনির মত জায়গা। ছাদ থেকে খুলে পড়েছে পাথরের পাতলা পড়ত। ঝকঝকে পরিস্কার পাথরগুলো দেখে সহজেই অনুমান করা যায় অল্পদিন আগে অথবা একক্ষুণই খুলে পড়েছে।

 

বৃষ্টির হাত থেকে রেহায় পাবার জন্য জায়গাটি উপযোগী তবে বিপদের কথা বিবেচনা করে কেটে পড়াটাই উত্তম মনে হল। খালে ঢল নেমেছে তাই বিপ্লব এবং জিবন ফেরার জন্য বিকল্প পথ খুঁজে বের করলো। খানিক এগিয়ে পাহাড়ের খাড়া শরীরে ঝুলন্ত লতা এবং শেকড় বাকড়কে অবলম্বন করে আরোহণ করতে হল ঝর্ণার একেবারে উপরে। দূর দূরান্ত থেকে প্রতিনিয়ত পানি এসে পড়ছে উপরের খালটাতে। সৃষ্টি হয়েছে নদীর মত এক স্রোতধারার। এই স্রোতধারায় সামান্য এগিয়ে পতিত হয়েছে জলপ্রপাতরূপে। খালের নামে নাম ধারণ করেছে পাইন্দু ঝর্ণা।

 

দীর্ঘক্ষণ বৃষ্টি আর খালের ঠাণ্ডা পানিতে ভিজে প্রত্যেকের শরীর কাঁপছে। কুকুর জেড়ারও একই অবস্থা। এইখান থেকে খালের উজানের পথটার কিছু জায়গা আরো বেশি বিপজ্জনক।

 

আমরা সবাই নিরাপদে এগিয়ে চলতে সক্ষম হলেও সমস্যা বাঁধল জুলিয়েটকে নিয়ে। এক পাথর থেকে আর এক পাথরে লাফিয়ে পার হতে সে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিপ্লব কি বসে থাকতে পারে। পাইন্দু খালের পানিতে ঝাপিয়ে পরল। বোল্ডারের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে প্রবল গতিতে নেমে আসছে পানি। তারই মাঝদিয়ে জুলিয়েটকে কোলে করে সাঁতরে পার হল।

 

Tags: