সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে সরকারি বাসভবন গণভবনে থেকে ভার্চুয়ালি এ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন অর্থবিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতেমা ইয়াসমিন।
আপাতত চার ধরনের পেনশন কর্মসূচি চালু করছে সরকার। এগুলো হলো- প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা। সবচেয়ে বেশি অর্থ জমার সুযোগ রাখা হয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য। তারা মাসে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা রাখতে পারবেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ইতিমধ্যে ‘সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা, ২০২৩’ জারি করেছে। সেখানে কোন শ্রেণির মানুষ, কোন ধরনের পেনশনে মাসে কত টাকা জমা দিয়ে নির্ধারিত মেয়াদ শেষে মাসে কত টাকা করে পাবেন, তা নির্ধারণ করা হয়েছে।
‘প্রবাস’ কর্মসূচি হচ্ছে প্রবাসীদের জন্য; প্রগতি কর্মসূচি হচ্ছে বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য; সুরক্ষা স্কিম হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক খাত অর্থাৎ স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য; আর সমতা স্কিম হচ্ছে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ‘ইউপেনশন’ নামক ওয়েবসাইটও উদ্বোধন করা হবে। এ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ওইদিন থেকে যে কেউ পেনশন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।
বিধিমালায় বলা হয়েছে, ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী জাতীয় পরিচয়পত্রধারী যে কোনো বাংলাদেশি নাগরিক পেনশন কর্মসূচিতে যুক্ত হতে পারবেন। এর বাইরে বিশেষ বিবেচনায় ৫০ বছরের বেশি বয়সীরাও যে কোনো ধরনের পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। তবে পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের জন্য পেনশন কর্মসূচি কী হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক, যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নেই, তারা পাসপোর্টের ভিত্তিতে নিবন্ধিত হতে পারবেন। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় থাকা ব্যক্তিও পেনশনের আওতায় আসতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় তারা যে সুবিধা ভোগ করে থাকেন, তা তাদের বাদ দিতে হবে।
দেশে বা বিদেশে থাকা বাংলাদেশি নাগরিকরা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত ফরম অনলাইনে পূরণ করে আবেদন করতে পারবেন। সেই আবেদনের বিপরীতে একটি স্বতন্ত্র নম্বর (ইউনিক আইডেনটিটি নম্বর বা ইউআইডি) দেওয়া হবে। আবেদনে উল্লেখ থাকা আবেদনকারীর মুঠোফোন নম্বর এবং প্রবাসীদের ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় ই-মেইলের মাধ্যমে ইউআইডি নম্বর, চাঁদার হার এবং মাসিক চাঁদা দেওয়ার তারিখ জানানো হবে।
‘প্রবাস’ কর্মসূচিতে ১৮ বছর বয়সী একজন প্রবাসী যদি মাসে ১০ হাজার টাকা করে জমা দেন, তবে ৪২ বছর পর তিনি মাসে পাবেন ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৬৫৫ টাকা করে। আবার ১৮ বছর বয়সী বেসরকারি কোনো চাকরিজীবী যদি মাসে ৫ হাজার টাকা করে জমা দেন, তা হলে তিনি ৪২ বছর পর মাসে পাবেন ১ লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা করে। সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায়ও ১৮ বছর বয়সীরা কেউ যদি ৫ হাজার টাকা করে মাসে জমা দিয়ে পেনশনে যুক্ত হন, তার হলে ৪২ বছর শেষে তিনিও মাসে ১ লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা করে পাবেন।
তবে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য নির্ধারিত সমতা পেনশন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের মাসিক চাঁদার অর্ধেক দেবে সরকার। সমতা কর্মসূচিতে একজন অংশগ্রহণকারীকে মাসে দিতে হবে ৫০০ টাকা, এর বিপরীতে সরকার দেবে আরও ৫০০ টাকা। এভাবে কেউ যদি ৪২ বছর ১ হাজার টাকা করে জমা দেন, তা হলে মেয়াদ শেষে তিনি মাসে পেনশন পাবেন ৩৪ হাজার ৪৬৫ টাকা করে।
বিধিমালায় আরও বলা হয়েছে, পেনশনের চাঁদা জমা দিতে হবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত ব্যাংক হিসাবে। আর জমা দেওয়া যাবে অনলাইন ব্যাংক, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান এবং তফসিলি ব্যাংকের যে কোনো শাখার মাধ্যমে।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চাঁদা দিতে না পারলে পরের এক মাসের মধ্যে জরিমানা ছাড়া চাঁদা দেওয়া যাবে। এক মাস পার হলে পরের প্রতিদিনের জন্য ১ শতাংশ হারে জরিমানা দিয়ে হিসাব সচল করা যাবে। মাসের নাম উল্লেখ করে অগ্রিম চাঁদা দেওয়ারও সুযোগ রাখা হয়েছে। চাঁদা মাসিক, ত্রৈমাসিক বা বার্ষিক ভিত্তিতে দেওয়ারও সুযোগ থাকবে।
চাঁদাদাতা নিজের ও পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা, গৃহনির্মাণ, গৃহ মেরামত এবং সন্তানের বিয়ের ব্যয় মেটাতে তার জমা করা অর্থের ৫০ শতাংশ ঋণ নিতে পারবেন, যা শোধ করতে হবে ২৪ কিস্তিতে।
সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে এ কর্মসূচি চালু করতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। পেনশন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। কর্তৃপক্ষের জন্য একটি স্বতন্ত্র অফিস প্রতিষ্ঠা করা হবে। বর্তমানে অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইয়াজদানি খানকে নিজ দায়িত্বের বাইরে পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়েছে অর্থ বিভাগ। বিধি অনুযায়ী এই দায়িত্ব পালন করার কথা সচিব পদমর্যাদার কোনো ব্যক্তির।
পেনশন বাবদ জমাকৃত অর্থের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে একটি ‘সর্বজনীন পেনশন তহবিল’ গঠন করা হবে। এ তহবিলে চাঁদা জমা, হিসাব সংরক্ষণ, পুঞ্জীভূত অর্থের সুষ্ঠু ও নিরাপদ বিনিয়োগ এবং পেনশন দেওয়াসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রম সম্পাদিত হবে। এক বা একাধিক তফসিলি ব্যাংকে তহবিলের অর্থ রাখা যাবে।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা পরিচালনায় আইন অনুযায়ী, একটি ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং এর প্রধান কার্যালয় হবে ঢাকায়। কর্তৃপক্ষের একজন নির্বাহী চেয়ারম্যান ও চারজন সদস্য থাকবেন। তারা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। তাদের চাকরির মেয়াদ ও শর্ত বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে। কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হবেন নির্বাহী চেয়ারম্যান। কর্তৃপক্ষসহ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সরকার বহন করবে।
পেনশন কর্তৃপক্ষ স্থাবর বা অস্থাবর উভয় প্রকার সম্পত্তি অর্জন এবং সম্পত্তি অধিকারে রাখতে ও হস্তান্তর করতে পারবে। সরকারের অনুমোদন নিয়ে নিজ নামে ঋণ নিতে পারবে। কর্তৃপক্ষ নিজ নামে মামলা দায়ের এবং আদালতের মাধ্যমে সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাব ক্রোক করতে পারবে। পেনশন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সুযোগও রাখা হয়েছে আইনে।
অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের একটি পেনশন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, এফবিসিসিআইর সভাপতি, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি, বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি এর সদস্য হবেন।