দীর্ঘ ৭০ বছর ভারতের দখলে থাকার পর ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার জগদল ও বেউরঝাড়ি সীমান্তবর্তী ৯১ বিঘা বাংলাদেশি জমি অবশেষে উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। সোমবার (৮ এপ্রিল) দুপুরে ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যেমে এ তথ্য জানায়। উদ্ধার করা জমিতে সাদা পতাকা (নিশানা) টানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী বাহিনী।
সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত ৯১ বিঘা জমিতে প্রবেশের অধিকার ফিরে পাওয়ায় সীমান্তবর্তী মানুষের মধ্যে আনন্দের বন্যা বইছে। জমিগুলো উদ্ধারে গত প্রায় ১ মাস আগে কাজ শুরু করে বিজিবি।
বাহিনীটি জানিয়েছে, ঠাকুরগাঁও ব্যাটালিয়ন (৫০ বিজিবি) এর সুচারু পরিকল্পনা এবং সময়োপযোগী উদ্যোগে বাংলাদেশ ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর এর প্রতিনিধি দলের সাথে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও সমন্বয় সাধন করে তারা।
সেই হিসাবে অধীনস্থ জগদল এবং বেউরঝাড়ি বিওপির দায়িত্বপূর্ণ সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশ-ভারতের সার্ভে বিভাগের যৌথ জরিপের মাধ্যমে ভারতের দখলে থাকা জগদল বিওপির দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় প্রায় ১৫ বিঘা জমি এবং বেউরঝাড়ি বিওপির দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় প্রায় ৭৬ বিঘা জমি (মোট ৯১ বিঘা) উদ্ধার করা হয়। বাংলাদেশের অনুকূলে প্রাপ্ত জমির মধ্যে ৭৭ বিঘা আবাদি জমি, ১১ বিঘা চা বাগান ও ৩ বিঘা নদীর চর রয়েছে।
ঠাকুরগাঁও ব্যাটালিয়ন স্ট্রীপ ম্যাপ পর্যালোচনা করে পূর্ব থেকেই নিশ্চিত ছিলো জমিগুলো বাংলাদেশের। বিজিবির আহ্বানে বিজিবি ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের মধ্যে অনুষ্ঠিত পতাকা বৈঠকে জমিগুলো বাংলাদেশের বলে বিজিবির পক্ষ হতে জোরালো দাবী উপস্থাপন করা হয়। পরে বিজিবির পক্ষ হতে আরও বলা হয় যে, বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য সার্ভেয়ারের মাধ্যমে যৌথ জরিপের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
উল্লিখিত ঘটনার প্রেক্ষিতে গত ৬ ও ৭ মার্চ বাংলাদেশ ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের সহকারী জরিপ ও চার্জ অফিসার এবং ভারতীয় সার্ভে বিভাগের সহকারী চার্জ অফিসার এর সমন্বয়ে— বিজিবি-বিএসএফ এর উপস্থিতিতে ঠাকুরগাঁও ব্যাটালিয়নের অধীনস্থ জগদল এবং বেউরঝাড়ি বিওপির দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় সীমানা নির্ধারণের লক্ষ্যে যৌথ জরিপ ও পরিদর্শন অনুষ্ঠিত হয়। সেই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গত ৬ মার্চ জগদল বিওপির দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে প্রায় ১৫ বিঘা ভারতের দখলে থাকা জমি বাংলাদেশের অনুকূলে পাওয়া যায় এবং অপরদিকে প্রায় ৭ দশমিক ৫ বিঘা বাংলাদেশের দখলে থাকা জমি ভারত পায়। এরপর গত ৭ মার্চ বেউরঝাড়ি বিওপির দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে প্রায় ৭৬ বিঘা ভারতের দখলে থাকা জমি বাংলাদেশের অনুকূলে পাওয়া যায়। অপরদিকে প্রায় ১৬ বিঘা বাংলাদেশের দখলে থাকা জমি ভারত পায়। উল্লেখ্য, উক্ত জরিপে বাংলাদেশের প্রাপ্ত জমির পরিমান ৯১ বিঘা এবং ভারতের প্রাপ্ত জমির পরিমান ২৩ দশমিক ৫ বিঘা।
বাংলাদেশ ও ভারতের সার্ভে বিভাগের যৌথ জরিপের মাধ্যমে প্রাপ্ত বাংলাদেশি জমিগুলো স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে প্রকৃত মালিকের নিকট হস্তান্তরের লক্ষ্যে ঠাকুরগাঁও ব্যাটালিয়ন (৫০ বিজিবি) এর পক্ষ হতে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসনের সাথে প্রয়োজনীয় সমন্বয় করা হয়েছে।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার জগদল সীমান্তবর্তী এলাকার ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধ আনসারুল ইসলাম বলেন, “আমি ছোটকাল থেকেই দেখে আসছি এই জমিগুলো ভারতের অধীনে এবং ভারতের লোকজন এগুলাতে চাষ করে আসছে। কিছুদিন আগেই জমিতে একজন বাংলাদেশি যাওয়ার কারণে তাকে গুলি করে মারা হয়। প্রায় ৭০ বছর পর আমরা জমিগুলো ফিরে পেয়েছি। এতে আমাদের মধ্যে অনেক বেশি আনন্দ-উৎসাহ বিরাজ করছে। আজকে থেকেই জমিগুলো আমরা চাষবাদ করতে পারব এবং এইগুলো বাংলাদেশের জমি, যেগুলো এতদিন ভারতের মানুষ ভোগ করে আসছিল।”
বেউরঝাড়ি গ্রামের সীমান্তবর্তী বাসিন্দা ফয়সাল বলেন, “এই যে গম ক্ষেত এটা ভারতের। আমি ছোটকাল থেকেই দেখতেছি। আমরা কখনো এই জমিতে যেতে পারি না। এই জমিতে ভারতের লোকজন চাষবাদ করে। আমাদেরকে কখনো যেতে দেয় নাই। এখন শুনতে পেয়েছি যে এই জমি নাকি বাংলাদেশ পেয়েছে। এতে আমাদের এলাকার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ উৎসব চলছে। সবার মনে অনেক আনন্দ। এখানে প্রায় ৭৬ বিঘা জমি পেয়েছে বাংলাদেশ। এগুলোতে আমাদের স্থানীয় লোকজন চাষবাদ করতে পারবে। নদী ভাঙতে ভাঙতে বাংলাদেশের দিকে আসছে। এর ফলে নদীর ওইপারে যে জমিগুলো রয়েছে সেগুলো বাংলাদেশের। জমিগুলো ভারত দখল করে নিয়েছিল। এখন বাংলাদেশ বিজিবি এটি উদ্ধার করেছে।”
ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবির অধিনায়ক লেঃ কর্নেল তানজীর আহম্মদ বলেন, “আমরা প্রাথমিকভাবে বুঝতে পারি যে এই জমিগুলো বাংলাদেশের এবং জগদল ও বেউরঝাড়ি সীমান্তের কিছু অংশ বাংলাদেশের জমি হিসাবে আমরা ধারণা করি। তারই প্রেক্ষিতে আমরা ভারতের সাথে কথা বলি এবং জরিপ করার জন্য আহ্বান জানাই। তাদেরকে আমরা অনুরোধ করি তারা যেন প্রকৃতপক্ষেই জমির মাপের কাজটি করা হয়। বাংলাদেশ বিজিবি এবং বিএসএফের যৌথ জরিপের মাধ্যমে আমরা এই জমিগুলো পেয়েছি।”
এ বিষয়ে জানতে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মাহাবুবুর রহমানের সঙ্গে বারবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।