muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

কিশোরগঞ্জের খবর

বাতাসে মাংসের গন্ধ, কিন্তু মুখ বন্ধ

আশরাফ আলী, সটাফ রিপোর্টারঃ

কথা রাখলেন কিশোরগঞ্জ এর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) তরফদার মোঃ আক্তার জামীল। বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে ঘোষিত জিরো টলারেন্স অবস্থান সমুন্নত রাখার অব্যাহত প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় ৮ আগস্ট ২০১৬ খ্রি. তারিখ সোমবার কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার বৌলাই ইউনিয়নের ভট্টাচার্য্য পাড়ায় আরও একটি বাল্য বিবাহের প্রচেষ্টাকে রুখে দিলেন তিনি। সপ্তাহান্তে এটি পঞ্চম অভিযান।

বেলা ১১:০০ টায় জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে চলছিল ১৫ আগস্ট এর উপ-কমিটির পর পর দু’টি গুরুত্বপূর্ণ একটি সভা। সেখানে তিনি আহবায়ক। এমন সময় তার মোবাইল ফোনে সংবাদ আসে ভট্টাচার্য্য পাড়ার কাঠ ব্যবসায়ী আলী হোসেনের কন্যা চুমকী এর বিবাহের আয়োজন করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এই সংবাদের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য দুইজন সংবাদকর্মীকে পাঠানো হয় ঘটনাস্থলে। দ্রুত সভার কাজ শেষ করে নিজ দপ্তরে সংবাদের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য অপেক্ষা করেন। ঠিক সেই মুহূর্তে অপর প্রান্ত হতে জানানো হল সংবাদখানা সঠিক। মেয়েটির স্কুলে দাখিলকৃত জন্ম সনদপত্রের তারিখ পাওয়া গেল-১৭/০৯/২০০৫ খ্রি.। হিসাব অনুযায়ী দেখা যায় কনের বয়স ১১ বৎসরের কাছাকাছি। সংবাদটি শোনার সাথে সাথে উদগ্রীব হয়ে গেলেন তিনি। তাৎক্ষণিক দাপ্তরিক সহকর্মীদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে। খবর দেয়া হল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। সঙ্গে এনজিও কর্মী, সংবাদকর্মীসহ যাত্রা করলেন কনের বাড়িতে। উপস্থিত থাকার জন্য বলা হল স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নিকট থেকে নেয়া হল কনের জন্ম সনদের কপি। বেলা ১:০০ টায় কনের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে দেখা যায় অনেক দূর থেকে সাজানো হয়েছে কনের বাড়ি। প্রায় আধা কিলোমিটার জুড়ে লাইটিং ও ডেকোরেশন। প্রবেশদ্বারে বিশাল গেইট। গাড়ি দেখে ছুটে আসা লোকজনের ভিড় ভেঙ্গে ভিতরে ঢোকার সাথে সাথে নজরে আসে বিশাল প্যান্ডেলের নীচে চলছে খাওয়া দাওয়ার ধুম।

adc-1adc-7

চারদিকে পোলাও মাংসের গন্ধ। বাড়ি ভর্তি মেহমান। আসতে বলা হল কনেসহ তার বাবা মাকে। খানা-পিনারত মেহমানরা সবাই হতবিহল। বাতাসে মাংসের গন্ধ থাকলেও সবার মুখ তখন সাময়িক বন্ধ। এতক্ষণ খানাপিনায় ব্যস্ত মেহমানদের উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বাল্য বিবাহের কুফল, সরকার ও জেলা প্রশাসনের অবস্থান, আইনগত পদক্ষেপ ও সরকারি নীতিমালা সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিলেন। বুঝাতে সক্ষম হলেন যে শুধু আয়োজন নয়, বাল্য বিবাহের আয়োজনে অংশগ্রহণ বা সহযোগিতাও বেআইনী। উপস্থিত সকলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এর ব্যাখ্যায় আশ্বস্ত হয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন তারা বাল্য বিবাহে কোন প্রকার সহায়তা বা অংশগ্রহণ করবেন না।

adc-2

অনেকের মুখে দেখা গেল অপরাধবোধের ছাপ। বিয়ে বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হলে কনের বাড়ির লোকজনদের মাঝে কিছুটা আতঙ্ক, কিছুটা অভিনয় ভাব লক্ষ্য করা গেল। অভূক্ত কনেকে কিছু খাওয়ানোর কথা বলে ঘরের ভিতরে ডেকে নিয়ে শেখানো হল অভিনব আরজি। কনে ঘরের বাহিরে এসে কান্নার সুরে বলতে লাগল “আমি ছেলেকে (হবু বর) ভালবাসি। ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো না, বিয়ে আমাকে আজই দিতে হবে’। কনের চাচা আরও এককাঠি উপরে। তিনি বলে উঠলেন-মেয়ে সারাদিন এই ছেলের সাথে মোবাইলে কথা বলে, তাই আমরা দ্রুত বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। মেয়ের সাথে ছেলের দীর্ঘ পাঁচ বছরের প্রেম। আমাদের কিছু করার নেই। বিয়ে না দিলে মেয়ে বাঁচবে না। বিষয়টি সম্পূর্ণ সাজানো ও অভিনয় বুঝতে পেরে আরও কঠোর হয়ে উঠলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক)।

adc-3adc-4

বাল্য বিবাহের মত অন্যায়ের পক্ষে সাফাই গাওয়া ও মেয়েকে বাল্য বিবাহে উৎসাহিত করায় চাচার জেল হতে পারে জানালেন। কনের বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। যখন বলা হল গার্ডিয়ানের পক্ষে অন্যদের ধরে নিয়ে যাওয়া হবে তখনই অনেকটা বিষন্ন মনে হাজির হলেন কনের বাবা আলী হোসেন। এতক্ষণ তিনি পাশেই ছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে কনের বাবাও চাচার সুরে বললেন হবু বরের সঙ্গে মেয়ের দীর্ঘদিনের জানাশুনা। তাই অপ্রীতিকর কিছু ঘটার আগেই বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। সূত্রমতে জানা গেল এটাও সর্ম্পূণ মিথ্যা ও বানানো কথা। স্থানীয় বৌলাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আওলাদ হোসেন এসে উপস্থিত হলেন। তিনি জানালেন জন্ম সনদ তার দেয়া। আজ নতুন আরও একটা জন্ম সনদ আনতে গিয়েছিলো। তিনি দেননি। এডিসি জেনারেলের আইনানুগ ব্যাখ্যা ও বাল্য বিবাহের কুফল সম্পর্কে বিচক্ষণ উপস্থাপনার একপর্যায়ে কনের বাবা সহ বাড়ির অন্যান্য লোকজন স্বীকার করে নিলেন বাল্যবিবাহ আয়োজন করে তারা ভুল করেছেন। এ পর্যায়ে কনের বাবাকে বাল্য বিবাহ অনুষ্টানের আয়োজন এবং চাচা সহযোগিতা করে আইন ভঙ্গ করায় প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। উপস্থিত স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেয়া হল বয়স পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এ বিয়ে হবে না। ভ্রাম্যমান আদালতের সংবাদ পেয়ে বরপক্ষ আর কনের বাড়িতে আসেনি।

adc-6adc-9

এরপর ভ্রাম্যমান আদালত নিয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইউনিয়ন চেয়ারম্যানসহ ছুটে গেলেন বরপক্ষের বাড়ি পাঠধা কুড়ের পাড় এলাকায়। সেখানে উপস্থিত ইউপি মেম্বারসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে বরপক্ষকে বাল্য বিবাহের বিভিন্ন নেতিবাচক দিক ও সরকারি বিধিমালা তিনি অবগত করান। বরের বাবা মো: হাফিজ উদ্দিন মুন্সী ও বর মাসুদকে জিঞ্জাসাবাদে জানা গেল মেয়ের সাথে ছেলের কখনই কোন প্রেমের সম্পর্ক ছিলো না। বর মাসুদ জানালেন মেয়েকে তিনি দুই সপ্তাহ আগে দেখেছেন। বাবা-মা পছন্দ করায় তিনি বিয়েতে রাজী হয়েছেন। তারা দু’জনেই স্বীকার করেন তারা ভুল করেছেন। সেখানেও বিধিবহির্ভূত বাল্য বিবাহ আয়োজনের জন্য বর ও বরের বাবা প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করে জরিমানা আদায় করে বন্ধ করে দেয়া হল অভিশপ্ত বাল্য বিবাহ। ভ্রাম্যমান আদালতের সংবাদ পেয়ে বিয়ে পড়াতে আসা কাজীর উর্ধ্বশ্বাসে পলায়নের দৃশ্য ছিল বিয়ে ভঙ্গের বিরহের মাঝে উপস্থিত উৎসুক জনতার একটু হাসির খোরাক।

 

 

মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ ডটকম/০৮-০৮-২০১৬ইং/ অর্থ 

Tags: